একবিংশ শতাব্দীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে পশুপালন, পোলট্রি শিল্প এবং মৎস্যচাষ হল সবথেকে দ্রুত এবং প্রগতিশীল একটা ক্ষেত্র, যেটা আমাদের এই জনবহুল দেশের সমস্ত মানুষের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে পারে। আমরা জানি ভারতবর্ষ কৃষিপ্রধান দেশ এবং বর্তমানে কৃষির পাশাপাশি পশুপালনও জীবিকা নির্বাহের একটি নির্ভরযোগ্য এবং বিশ্বস্ত পাথেয়। বর্তমান পৃথিবীর খাদ্য উৎপাদন ও চাহিদা আমাদের আগামী পৃথিবীর খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে ভাবিয়ে তুলেছে। সমগ্র পৃথিবীর মানুষকে আজ চ্যালেঞ্জ করে বসেছে অতি আণুবীক্ষনিক ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও বিভিন্ন অণুজীব।
শিল্পায়নের প্রসারতায় আমারা আমাদের চারপাশের পরিবেশকে বিষিয়ে তুলেছি। উঁচুশ্রেণীর মানুষের সুখের যোগান দিতে গিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত তৈরি করে চলছি হাড্ডি চর্মসার তৃতীয় বিশ্ব। ভাবছেন, তাহলে আমাদের কি মহা বিলুপ্তি ঘটবে ? না।
আর এই ‘না’ বলার নিশ্চয়তা আপনাকে দিতে পারে ‘জৈবপ্রযুক্তি বা বায়োটেকনোলোজি’ । আসলে ‘জৈবপ্রযুক্তি বা বায়োটেকনোলোজি’ হচ্ছে জীববিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সমন্বয়। জীববিজ্ঞান বা বায়োলজির জ্ঞানকে মানুষের/সমাজের কল্যাণে নিয়ে আসাটাই হল ‘জৈবপ্রযুক্তি বা বায়োটেকনোলজি’। বস্তুত বিজ্ঞানের এই শাখাটি বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার সাথে সেতুবন্ধন রচনার মাধ্যমে আমাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছে নতুন এক পৃথিবীর ।
এবার একনজরে দেখে নেওয়া যাক, জীবপ্রযুক্তি ক্রমাগত বছরের পর বছর কিভাবে পশু-স্বাস্থ্য ও পশু-প্রজননের উপর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে চলেছে ।
১. উন্নত গুণমান সম্পন্ন এবং উচ্চফলনশীল প্রাণী উৎপাদনঃ
পশুপালনের পুরানো ঘরানার পন্থা গুলোকে ছেঁটে ফেলে যদি আমরা জৈবপ্রযুক্তি পদ্ধতিকে আপন করে নিই, তবে উন্নত গুণগতমান সম্পন্ন ও কার্যকরী পশু উৎপাদন করতে সক্ষম হব ।
এই টেকনোলজির অন্যতম নিদর্শন হল, ট্রান্সজেনিক বা ক্লোন প্রাণী, উদাহরণ- ইঁদুর, খরগোশ, শূকর, ভেড়া, ছাগল, গরু ইত্যাদি। ট্রান্সজেনেসিস হলো এমন একটি পদ্ধতি, যেখানে বহিরাগত বা পরিবর্তিত জিনকে দেহের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে তার গুনগতমানকে বৃদ্ধি করা হয়। এই পদ্ধতির সাহায্যে আমরা জীব উৎপাদনের হার ও তাদের থেকে প্রাপ্ত খাদ্যের গুণগত মান বাড়াতে সম্ভব হয়েছি। উদাহরণস্বরূপঃ ট্রান্সজেনেসিস পদ্ধতিতে উৎপন্ন গরুর দুধ থেকে প্রাপ্ত 'মানব প্রোটিন' মানুষের এম্পাইসেমা (emphysema) নামক রোগের (শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগ) চিকিৎসাতে ব্যবহৃত হয় । ক্লোন করা গরুর দুধে দেখা গেছে, কাপ্পা (kappa) এবং বিটা কেসিন (Beta Casein) এর পরিমাণ বাড়ানো সম্ভবপর হয়েছে । ফলস্বরূপ এই সমস্ত গরু থেকে প্রাপ্ত দুধে ল্যাকটোজ (Lactose) এর পরিমাণ কম করা সম্ভব হয়েছে, এর সাথে কোলেস্টেরল (cholesterol) এর পরিমাণকে কমানো সম্ভবপর হয়েছে । তাছাড়া শূকর ও গরুর মাংসপেশী বৃহদাকার আকৃতি বানানোও সম্ভবপর হয়েছে, যার ব্যবসায়িক গুরুত্ব অনেকাংশেই বেশি। এছাড়া এই প্রযুক্তি কে কাজে লাগিয়ে ভেড়ার শরীরে উলের পরিমান বাড়ানোও সম্ভবপর হয়েছে।
২. পশু-উৎপাদিত বস্তুর গুণগতমান বৃদ্ধিঃ
পশু-উৎপাদিত বস্তুর মধ্যে মূলত দুধ আর মাংসের কথাই আমরা আলোচনা করব। আমাদের সমাজে অধিকাংশ মানুষই আমিষভোজী, তাই তাদের খাদ্যের যোগানের জন্য অনেক পরিমাণ মাংসের দরকার। জীবপ্রযুক্তিবিদ্যা এনে দিয়েছে এই সমস্যার সমাধান। এই টেকনোলজি বহুল ভাবে প্রচলিত হয় পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিতে। বিভিন্ন জিনের সংযোজন ও বিয়োজনের মধ্যে অধিক মাংস সম্পন্ন, পেশীবহুল, পোলট্রি, ছাগল তৈরি করা সম্ভবপর হয়েছে। মাংস উৎপাদনের শিল্পে বিভিন্ন জৈবপ্রযুক্তিগত সরঞ্জাম ব্যবহারের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা মাংসের গুণগতমান বৃদ্ধিতে সক্ষম হয়েছেন। নির্দিষ্ট জিন প্রয়োগের মাধ্যমে কোলেস্টেরল (Cholesterol ও ফ্যাট (fat) এর মাত্রা ও নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে ।
৩. কৃত্রিম হরমোন উৎপাদনঃ
জীবপ্রযুক্তি কে কাজে লাগিয়ে শুকরের দেহ থেকে কৃত্রিমভাবে হরমোন প্রস্তুত করা সম্ভব হয়েছে। আমরা জানি প্রতিটি প্রাণীর দেহে অবস্থিত 'পিটইুটারী' নামক এক গ্রন্থি থেকে 'সোমাটোট্রপিন' (somatotropin) নামক হরমোন প্রস্তুত হয়। আর আমরা এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে শুকরের দেহে pST নামক একটি জিনকে ইনজেকশন এর মাধ্যমে প্রবেশ করিয়ে কৃত্রিম ভাবে 'সোমাটোট্রপিন' (somatotropin) হরমোন প্রস্তুত করতে সক্ষম হয়েছি, যার ব্যবসায়িক গুরুত্ব অপরিসীম ।
৪. কার্যকরী উৎসেচক উৎপাদন -
দুগ্ধ শিল্পের প্রধান কাঁচামাল হল উৎসেচক, যা রেনেট (Rennet) নামে পরিচিত । এর ভূমিকা অপরিসীম, কেননা দই থেকে শুরু করে ছানা, চিজ, পনির সবেতেই উৎসেচকের অবদান অনস্বীকার্য। এই বৃহৎ পরিমান উৎসেচকের জোগান দিতে দিশা দেখিয়েছে এই জৈবপ্রযুক্তি বিদ্যা। প্রধানত এই রেনেট (Rennet) প্রস্তুত করা হয় বাছুর থেকে, কিন্তু ক্রমশ তাও কমে যাওয়ার জন্য বিকল্প হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে এই জীবপ্রযুক্তির পন্থাকে, কৃত্রিম ভাবে ছত্রাকের দেহ থেকে 'Galactosidase' নামক উৎসেচক তৈরি করা সম্ভব, যা ল্যাকটোজ (lactose) কে ভেঙে গ্লুকোজ (glucose) ও গালাকটোজ (galactose) এ পরিণত করে । তাছাড়া বিভিন্ন মাইক্রোঅর্গানিজম যেমন ঈস্ট (yeast), মোল্ড (mould) থেকেও বিশুদ্ধ উৎসেচক উৎপাদন করা যায়। এছাড়া E.coli-এর শরীর থেকে কৃত্রিম ভাবে বিশুদ্ধ কাইমোসিন (Chymosin) তৈরি করা যায়, যেটা 'চিজ' প্রস্তুত করতে বিশেষ অবদান রাখে ।
অ্যান্টিবায়োটিক ও ভ্যাকসিনঃ
জীবপ্রযুক্তি বিদ্যা কে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন লাইভস্টক পশুদের ওপর জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং Recombinat DNA Technology এর কার্যপ্রণালীর ওপর নির্ভর করে প্রস্তুত করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরণের অ্যান্টিবায়োটিক (Antibiotic) এবং ভ্যাকসিন (Vaccine) প্রস্তুত করা হচ্ছে, যা সমাজের উন্নয়নের জন্য অগ্রণী ভূমিকা বহন করে চলেছে। তাছাড়া কোনো ওষুধ কিংবা ভ্যাকসিন এর পাইলট টেস্টিং এইসব প্রাণীদের ওপরেই হয় ।
৫. উপজাত (byproduct) বস্তুর যথোপযুক্ত ব্যবহারঃ
গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া ইত্যাদি পশুদের এক অদ্ভুত আন্তরিক গঠন আছে, যেখানে তাদের পাকস্থলীটা অনেক বড়ো, তার মধ্যে 'রুমেন' নামক অংশটি বেশ বড় । আমাদের সমাজের অবাঞ্ছিত খাদ্যবস্তু (ধানের খড়/বিচালি, খুদ, ভুষি, দৈনন্দিন এর ব্যবহৃত বস্তুর অবশিষ্ঠাংশ ইত্যাদি) যেগুলো মানুষের খাদ্যোপযুক্ত নয়, সেগুলোই ওই 'জাবর-কাটা প্রাণী' গুলো গোগ্রাসে গিলে নেয় বিনা দ্বিধায় এবং সেই খাদ্যবস্তুর বিশেষ প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে তারা তাদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি সংগ্রহ করে নেই, শুধুমাত্র তাদের দেহে উপস্থিত লক্ষাধিক উপযোগী অণুজীবের সাহায্যে। জীবপ্রযুক্তির সাহায্যে আমরা ওই প্রাণীদের পাকস্থলীতে মূলত 'রুমেন' এ মাইক্রো-অর্গানিজম-এর সংখ্যা বাড়াতে পারি, যার ফলে আমাদের দেওয়া খাদ্যবস্তুর সর্বোত্তম ব্যবহার করা সম্ভব হবে এবং পশুর অভ্যন্তরীণ খাদ্যবস্তুর পাচন ক্ষমতা বাড়বে ।
৬. গুণগত মান নির্ধারণঃ
'খাদ্যে গুনাগুন নির্ধারণ ও নিরাপত্তা'র ক্ষেত্রেও জীবপ্রযুক্তির সরঞ্জাম এর কথা উল্লেখ হয়েছে যেমন- rDNA টেকনোলোজি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, PCR, Microarray ইত্যাদি। RAPD এবং RFLP এই পদ্ধতির সাহায্যে আমরা দুটো প্রজাতির (এক/ভিন্ন), উপজাতির, স্ট্রেইনের মধ্যে তুল্যমূল্য বিচার করতে পারি। তাছাড়া এই সমস্ত প্রাণীদের রোগ নির্ধারনের জন্য এই টেকনোলজি বহুল ভাবে ব্যাবহৃত হয়।
উপসংহারঃ
পশুপালন ও পশুজাত দ্রব্য উৎপাদন পদ্ধতিতে জীবপ্রযুক্তি নিয়ে এসেছে এক আমূল পরিবর্তন। এর ফলস্বরূপ আমরা পেয়েছি অধিক উৎপাদনশীল এবং উচ্চ গুণগতমান সম্পন্ন পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ্য, যা আমাদের বর্তমান সমাজের খাদ্য সংকট থেকে মুক্তির পথ দেখাবে। পুষ্টিকর খাদ্য জোগানের পিছনে এই টেকনোলোজির অবদান সত্যিই অনবদ্য, যা ভবিষ্যতের জন্য নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।
এই প্রযুক্তিকে হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছে অনেক কৃষক ভাই এবং তারা আশার আলো দেখছে। আমরা জানি ভোগকারী বাজারে (consumer market) সর্বদা সেইসমস্ত পণ্য বস্তুগুলোই দাম পায়, যেগুলির পুষ্টিগত মান বেশি, অর্ধায়ু-কাল বেশি, অধিক গুণমান সম্পন্ন, আর এই চাহিদা গুলো পূরণ করা সম্ভব শুধুমাত্র এই প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারে।
আরও পড়ুন - পোকার আক্রমণে পেঁয়াজ ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে? জানুন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ (Onion Crop Pest Management)
Share your comments