তিলাপিয়া হল এমন একটি মৎস্য প্রজাতি, যেটিকে গ্রীষ্ম-মণ্ডলীয় এবং প্রায়-গ্রীষ্ম-মণ্ডলীয় দেশগুলিতে ব্যাপকভাবে চাষ করা হয়। এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য-মাছ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে উচ্চ অর্থনৈতিক গুরুত্ব বহন করে। উৎপত্তিগত ভাবে, তিলাপিয়া আফ্রিকার স্বাদুজলের মাছ। এই মাছটি প্রাকৃতিকভাবে সারা বছরব্যাপী পুকুর, খাল, বিল, হ্রদ, মোহনা, আধার প্রভৃতিতে প্রজননে সক্ষম।
তিলাপিয়ার বিস্তৃতি ও গুরুত্বঃ
- এই মাছটি “সিচলিড” ফ্যামিলি এবং “পারসিফরম” অর্ডারের অন্তর্ভুক্ত।
- এই মাছটি সহজেই স্বাদুজল, নোনাজল এবং ঘোলাজলে চাষযোগ্য।
- এটি ৬-৮ মাসে ৫০০-৬০০ গ্রাম বৃদ্ধি পেতে পারে।
- এই মাছটি সুস্বাদু, দ্রুতবর্ধনশীল প্রকৃতির হওয়ায় এবং মাংসপেশির মধ্যবর্তী অস্থির অনুপস্থিতির জন্য “জলজ মুরগী’’ নামে পরিচিত।
সনাক্তকরণ বৈশিষ্ট্য-সমুহঃ
- এদের দেহ দীর্ঘায়ত, গভীর এবং সংকুচিত হয়।
- এদের দেহের উপরিভাগ নিম্নভাগের তুলনায় অবতল প্রকৃতির হয়।
- এদের পুচ্ছ পাখনার প্রান্তদেশ ছাঁটানো প্রকৃতির হয় এবং তাতে গোলাকার প্রান্ত থাকে।
- এদের মুখগহ্বরটি বৃহৎ প্রকতির হয়।
- স্ত্রী ও অপরিণত পুরুষ মাছের ক্ষেত্রে দীর্ঘতম নরম পৃষ্ঠদেশীয় রশ্মি পুচ্ছ পাখনার নিকটবর্তী অংশের উপরিভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে।
- প্রজননকালে পুরুষমাছের দেহটি গাঢ় কৃষ্ণবর্ণের হয়, মাথার নিম্নভাগ ফ্যাকাসে ধূসর-সাদা হয় এবং উপরের ঠোঁটটি নীলাভ বর্ণের হয়।
- স্ত্রী এবং অপ্রজননরত পুরুষ মাছ ধূসর হলদে বর্ণের হয়।
খাদ্য ও খাদ্যাভাসঃ
- এরা তৃণভোজী এবং শৈবাল, ডেত্রিটাস খেয়ে বেঁচে থাকে।
- প্যারেন্টাল কেয়ারের উপর ভিত্তি করে, তিলাপিয়াকে আমরা কয়েকটি ভাগে ভাগ করতে পারি।
১। ম্যাটারনাল- মাউথ ব্রিডারঃ ওরিক্রোমাস নাইলোতিকাস, ওরিক্রোমাস মোসাম্বিকাস।
২। প্যাটারনাল-মাউথ ব্রিডারঃ স্যারোথেরোডোন গ্যালিউস, স্যারোথেরোডোন ম্যাক্রোসেফালাস।
ব্রুডস্টক পরিচর্চাঃ
- এই মাছগুলিকে জলাধারের মধ্যে পালন করা হয় এবং তার সাথে প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার সরবরাহ করা হয়।
- তিলাপিয়া ৩-৪ মাসের মধ্যে পরিণত হয়, ভারতবর্ষের মত গ্রীষ্ম-প্রধাণ দেশে।
- প্রত্যেক স্ত্রীমাছ ৫০০-১০০০ ডিম উৎপাদনে সক্ষম।
- পুরুষ মাছের বৃদ্ধি স্ত্রী মাছের তুলনায় অনেক দ্রুত হারে হয়।
- সিমেন্ট-নির্মিত জলাধারে পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে ১:৩ অনুপাতে ছাড়া হয়।
- পুরুষ মাছ জলাধারের নিম্নভাগে “লেক” নামক জনন বসতি তৈরী করে এবং স্ত্রী মাছকে প্রজননের জন্য আহ্বান জানায়।
- প্রজননের পর স্ত্রীমাছটি নিষিক্ত ডিমগুলিকে মুখে নিয়ে জনন বসতি ছেড়ে চলে যায়।
- পুরুষ মাছটি এই জনন প্রক্রিয়াটি চালিয়ে যেতে থাকে।
- একটি পুরুষ মাছ খুব অল্প সময় মধ্যে অনেকগুলি স্ত্রী মাছের সাথে জনন ক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে।
ডিমের পরিস্ফুটনঃ
স্ত্রী মাছের মুখগহ্বরে থেকে পরিপক্ক ডিমগুলি স্ত্রী মাছের মুখে প্রফিত হয় অথবা যান্ত্রিকভাবে এদের স্ত্রীমাছের মুখ থেকে বের করে প্রবহমান জলের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হয়।
এই ডিমগুলি ২৬-২৮ ডিগ্রীতে ৩ দিনের মধ্যে ফোটে ।
এদের মজুত ঘনত্ব ৫০০০ ডিম/লিটার।
ডিমপোনার প্রতিপালনঃ
কুসুমযুক্ত ডিমপোনাগুলিকে অ্যালুমিনিয়ামের বা প্লাস্টিকের তৈরী ছিদ্রযুক্ত ৪০ সেন্টিমিটার, ২৫ সেন্টিমিটার, ১০ সেন্টিমিটার মাপের আয়তাকার পাত্রের মধ্যে প্রবহমান জল দিয়ে প্রতিপালন করা হয়। কুসুমটি সম্পূর্ণভাবে ৮- ১০ দিনে শোষিত হয়। ২০ দিন পর, ডিমপো্না গুলিকে প্রস্তুত নার্সারিতে স্তানান্তরিত করা হয়। এই পোনাগুলিকে ৪০% প্রোটিন সমৃদ্ধ টুকরো খাবার প্রদান করা হয়।
উপসংহারঃ
উষ্ম ও স্বাদুজলে মৎস্য চাষের ক্ষেত্রে তিলাপিয়ার চাষ অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য। খুব অল্প মূলধন বিনিয়োগের মাধ্যমে এই মাছটিকে গ্রীষ্ম ও প্রায় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশগুলিতে চাষ করা যায়। তিলাপিয়ার শক্ত মাংসপেশি এবং মৃদু গন্ধের জন্য এই মাছটিকে পশ্চিমী দেশগুলিতে খুব ব্যাপকভাবে বাজারজাত করা সম্ভব হয়েছে। বিগত ১০ বছরে এই মাছটি বাজারে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। অনুকূল তাপমাত্রা বজায় রাখলে এই মাছটি বিভিন্ন ভাইরাল, ব্যাকটেরিয়াল এবং পরজীবী-ঘটিত রোগের বিরুদ্ধে স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে পারে। এই সমস্ত সুবিধার জন্য তিলাপিয়া খুব কম খরচে চাষযোগ্য লাভজনক মাছের তালিকায় আছে এবং রেনবো-ট্রাউটের মত আরও অনেক মাছকে প্রতিযোগিতা দেওয়ার ক্ষমতা।
নিবন্ধ - শতরূপা ঘোষ
Image Source - Google
Related Link - অভিনব ও ভিন্ন প্রজাতির মৎস্য চাষে (Different species of fish) প্রথম পশ্চিমবঙ্গ
Share your comments