বিগত প্রায় ১১ বছরেরও অধিক সময় ধরে আমাদের রাজ্য তথা পশ্চিমবঙ্গ (West Bengal) মৎস্য- উৎপাদনে প্রথম স্থান অধিকার করে আসছে। কিন্তু তার পাশাপাশি আমাদের রাজ্যের জনসংখ্যার চাপও পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে। তাই মৎস্য উৎপাদন বাড়ানোর চাহিদা রয়েই যাচ্ছে। শুধু মাত্র মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রে নয়, আমাদের রাজ্য মাছের চারা উৎপাদনের ক্ষেত্রেও এগিয়ে আছে। রাজ্যের মোট মৎস্য উৎপাদনের ৭৫% পশ্চিমবঙ্গ থেকেই আসে।
যেহেতু গ্রামীণ অর্থনীতির সাথে মাছের উৎপাদনের গভীর সম্বন্ধ আছে, তাই মাছের উৎপাদনকে বহুগুণ বাড়িয়ে নিতে, চাষীদের মাছ চাষের খুঁটি-নাটি বিষয় সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা দরকার। যেমন- মাছ চাষে (Fish Farming) কি ধরণের খাদ্য কতটা পরিমাণে প্রয়োগ করতে হবে, তা চাষীদের জানতে হবে।
বাণিজ্যিক ভাবে মাছচাষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা হিসেবে পরিচিত। আর মাছ চাষের ৬০-৮০% খরচ ব্যয় করতে হয়, মাছের খাদ্যের ওপর। তাই খাদ্যের এফসিআর ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সম্যক ধারণার প্রয়োজন।
আধুনিক মাছ চাষে মাছের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন সম্পূরক খাদ্য। আর এই মাছের খাবারের (Fish Feed) আধুনিক প্রযুক্তি হল ভাসা খাবার। এই খাদ্য জলে ভেসে থাকতে পারে, ফলে মাছের খেতে সুবিধা হয়। কিন্তু সাধারণ মাছ চাষিদের এই খাবার প্রয়োগ সম্পর্কে সম্যক ধারণা তেমন নেই। মাছ চাষে এফ সি আর হল খাদ্য রূপান্তর হার , অর্থাৎ ১ কেজি মাছ উৎপাদন করতে কত কেজি খাদ্যের প্রয়োজন হয় তার অনুপাতকেই খাদ্যে এফ সি আর মান বলা হয়। উদাহরন স্বরূপ বলা যায়, এক কেজি মাছ উৎপাদন করতে যদি ১.৫ কেজি খাদ্যের প্রয়োজন হয় তাহলে উক্ত তেলাপিয়া মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রে মাছের এফসিআর হবে ১ : ১.৫ । খাদ্যের এফসিআর মান জানলে এক কেজি মাছের উৎপাদন খরচ কত তা অতি সহজেই অনুমান করা যায়।
মাছের দৈনিক খাদ্যের পরিমাণ (The Amount Of Daily Fish Feed) -
পুকুরে মাছের দৈনিক খাদ্যের পরিমাণ নির্ণয় করার জন্য নিম্ন লিখিত বিষয় গুলির উপর নজর রাখতে হবে। যেমন -
-
পুকুরে মাছের চারা ছাড়ার সংখ্যা, মাছের বাঁচার হারের ওপর নির্ভর করে মাছের খাদ্য দিতে হবে।
-
প্রতি ১৫ দিন অন্তর মাছের গড় ওজন নিয়ে প্রতিদিনের গড় বৃদ্ধির হার নির্ণয় করে খাদ্য তালিকা অনুযায়ী মাছের জন্য প্রতিদিন কত খাদ্য দরকার তা নির্ধারণ করতে হবে।
-
জলের তাপমাত্রার ওপর বিশেষ নজর দিতে হবে। কারণ, তাপমাত্রার তারতম্য মাছের খাদ্য গ্রহন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ২৮-৩২ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা মাছ চাষের অনুকূল পরবেশ। তাপমাত্রা কমে গেলে মাছ খাদ্য কম করে। প্রতি ৭-১০ দিন অন্তর জলের স্বচ্ছতার উপর নজর রাখতে হবে। জলের স্বচ্ছতা ৩০-৪০ সেন্টিমিটারের মধ্যে থাকা দরকার। জলের স্বচ্ছতা খুব কমে গেলে এবং জলের রঙ ঘন সবুজ হলে জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমান কম হবে, ফলে মাছের খাদ্য গ্রহন প্রক্রিয়া ব্যহত হবে। নিয়মিত জলের অক্সিজেন মাত্রার উপরও নজর রাখতে হবে।
-
নিয়মিত জলে চুন প্রয়োগ করে জলের পি এইচ মাছ চাষের অনুকূল রাখতে হবে।
মাছ চাষের অনুকূল অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একটি মডেল (Fish Farming Model) –
খাদ্য তালিকায় ২৫-৫০ গ্রাম গড় ওজনের প্রতিটি মাছের জন্য দৈনিক মোট খাদ্য ২ গ্রাম । এই মোট ২গ্রাম দৈনিক খাদ্যের ৫০ শতাংশ সকাল ৬.৩০ থেকে ৭.৩০ এবং বাকি ৫০ শতাংশ বিকেল ৩.৩০ থেকে ৪.৩০টায় দিতে হবে। অনুরূপভাবে ৫০ গ্রামের উপর - ১০০ গ্রাম গড়ওজনের প্রতিটি মাছের জন্য দৈনিক মোট খাদ্য ৩ গ্রাম ; ১০০ গ্রামের উপর - ১৫০ গ্রাম গড়ওজনের প্রতিটি মাছের জন্য দৈনিক মোট খাদ্য ৩.৫ গ্রাম ; ১৫০ গ্রামের উপর -
২০০ গ্রাম গড়ওজনের প্রতিটি মাছের জন্য দৈনিক মোট খাদ্য ৪ গ্রাম ; ২০০ গ্রামের উপর- ২৫০ গ্রাম গড়ওজনের প্রতিটি মাছের জন্য দৈনিক মোট খাদ্য ৪.৫ গ্রাম । এগুলো ৫০ শতাংশ সকাল ৬.৩০ থেকে ৭.৩০ এবং বাকি ৫০ শতাংশ বিকেল ৩.৩০ থেকে ৪.৩০ টায় দিতে হবে ।
এরপর থেকে ২৫০ গ্রামের গড়ওজনের উপরের মাছের জন্য মোট দৈনিক খাদ্যের ৪০ শতাংশ সকাল ৬.৩০ থেকে ৭.৩০ , মোট দৈনিক খাদ্যের ২০ শতাংশ দুপুর ১০.৩০ থেকে ১১.৩০ এবং বাকি ৪০ শতাংশ বিকেল ৩.৩০ থেকে ৪.৩০.
কয়েকটি উদাহরন দিয়ে মাছের কতটা খাদ্য প্রয়োজন, তা খাদ্য তালিকা অনুযায়ী ব্যাখ্যা করা যাক।
ধরা যাক, একটি পুকুরে ১০০০ টি ২৫ গ্রাম ওজনের চারা পোনা ছাড়া হয়েছে। তাহলে ২৫ গ্রাম মাছের জন্য প্রতিদিন ২ গ্রাম খাদ্য দরকার। তাহলে ১০০০ টি মাছের জন্য প্রতিদিন খাদ্য দরকার ১০০০ X ২ গ্রাম = ২০০০ গ্রাম বা ২ কেজি । পুকুরে মাছের জন্য ২ কেজি খাদ্য দরকার। পুকুরে প্রতিদিন দুবার খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে । সকাল (৬.৩০ – ৭.৩০) ১ কেজি ও বিকেল (৩.৩০- ৪.৩০) ১ কেজি খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে।
আবার পুকুরে ১০০০ টি ২৫ গ্রাম ওজনের চারা পোনা ছাড়ার ৬০ দিন পর প্রতি মাছের ওজন যদি ১৬০ গ্রাম হল এবং মাছের বাঁচার হার ৯০ শতাংশ হল (অর্থাৎ ৯০০ টি মাছ বেঁচে আছে) তাহলে খাদ্য তালিকা অনুযায়ী একটি ১৬০ গ্রাম মাছের জন্য ৪ গ্রাম খাদ্য দরকার ।
খাদ্য ছড়ানোর পর মাছ চাষিকে অবশ্যই নজর রাখতে হবে, এবং প্রয়োজনে মাছের খাদ্যের পরিমান বাড়াতে বা কমাতে হবে।
যদি দেখা যায় খাদ্য প্রয়োগের ২৫-৩০ মিনিটের মধ্যে সমস্ত খাদ্য মাছ খেয়ে নিয়েছে তবে বুঝতে হবে খাদ্যের পরিমাণ ঠিক আছে। যদি খাদ্য সম্পূর্ন না খেয়ে থাকে, তবে পরবর্তী সময়ে ( দুপুর বা বিকাল) খাদ্যের পরিমাণ কমাতে হবে।
অনুরূপভাবে পরবর্তী সময়েও (দুপুর বা বিকাল) দেখতে হবে ২৫-৩০ মিনিটের মধ্যে সমস্ত খাদ্য মাছ খেয়ে নিয়েছে কি না ? যদি খাদ্য সম্পূর্ণ না খেয়ে থাকে তবে পরবর্তী সময়ে খাদ্যের পরিমান কমাতে হবে। আর যদি দেখা যায় খুব তাড়াতাড়ি মাছ খাদ্য খেয়ে নিয়েছে এবং খাদ্যের জন্য ঘোরাঘুরি করছে তাহলে পরবর্তী সময়ে খাদ্যের পরিমাণ বাড়াতে হবে।
প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্য পুকুরে পাড় দিয়ে পুকুরের জলের চারিদিকে সমপরিমান হারে ছড়িয়ে দিতে হবে । লক্ষ্য রাখতে হবে হাওয়ার প্রতিকূলতায় ভাসমান খাদ্য যেন পুকুরের কিনারায় চলে না আসে।
আরও পড়ুন - Duck Farming - হাঁসের বিভিন্ন প্রজাতি ও তার পালন পদ্ধতি
নৌকা বা ভেলা তৈরি করে প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমান খাদ্য জলে সমপরিমান হারে ছড়িয়ে দিতে হবে। সর্বদা একটি বিষয়ের উপর লক্ষ্য রাখতে হবে যে, খাদ্য সব সময় নির্দিষ্ট অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে হবে কারণ মাছ কিছু দিনের মধ্যে ঐ নির্দিষ্ট অঞ্চলে খাদ্য খেতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে।
Share your comments