সারা বিশ্বের মানচিত্রে পার্শে একটি অন্যতম মাছ, বাড়ির পুকুরে কিংবা বাণিজ্যিকভাবে পার্শে চাষে (Mullet Fish Farming) লাভবান হতে পারেন চাষিরা। উপকূলীয় জলাশয়গুলিতে চিংড়ি চাষের পাশাপাশি পার্শে মাছ চাষ করা সম্ভব এবং এতে উপকূলীয় অঞ্চলে মাছ চাষে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। সারা বিশ্বের মানচিত্রে পার্শে একটি অন্যতম মাছ। আমাদের বাড়ির পুকুরে মিশ্রচাষ (Mixed Farming) কিংবা বাণিজ্যিক ভাবে পার্শে চাষে লাভবান হতে পারেন চাষিরা ।
পার্শে মাছ অতি সুস্বাদু। অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে এ মাছের চাহিদা রয়েছে। অগভীর উপকূলীয় জলাশয়, খাড়ি অঞ্চলে এবং মোহনা সংলগ্ন নদীতে মাছ পাওয়া যায়।
সাধারন নাম মালেট। চলতি কথায় অনেকে ‘তারই মাছ’ বলে থাকেন। ভাল বাংলায় পার্শে মাছ বলা হয়। ঈষৎ নোনাজলের মিশ্রচাষের জন্য এই মালেট একটি অন্যতম মাছ।
স্বাদে অতুলনীয়, বাজারে ভালোই চাহিদা রয়েছে এই মাছটির। খুব প্রাচীন সময় থেকে পার্শে মাছ উল্লেখ আছে বিভিন্ন দেশে। পাওয়া যায় আমাদের এখানেও। তবে পার্শে মাছের চিরাচরিত পদ্ধতিতে ধরেই পাওয়া যায়। নদী মোহনা থেকে প্রাকৃতিক উপায়ে পার্শে চারা পাওয়া যায়। তবে মৎস্য বৈজ্ঞানিকদের পার্শে মাছের কৃত্রিম প্রজননের চেষ্টায় বানিজ্যিক চাষের সম্ভবনা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন পার্শে মাছ যেমন নদী থেকে ধরে পাওয়া যায় তেমনি পার্শে মাছের চাষও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পার্শে মাছ পাওয়া যায়। কোথাও মুখ্য জলজ ফসল কোথাও সাথী জলজ ফসল হিসেবে চাষ করা হয়। তবে সব দেশেই প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে পার্শে মাছ ধরা ও উৎপাদনের মাধ্যমে পার্শে মাছ বাজারজাত করা হয়। ইতালি, ইসরায়েল, মিশর, মেক্সিকো, পেরু, হংকং, সিঙ্গাপুর, গ্রীস ও চীনের তাইওয়ান পার্শে মাছের উৎপাদন সব থেকে বেশি।
বিভিন্ন দেশে প্রথাগত বিভিন্ন চাষ পদ্ধতিতে পার্শে মাছের চাষ হয়।
বিভিন্ন দেশের এই প্রথাগত পার্শে মাছের চাষ পদ্ধতি কি রকম ?
যেমন ইতালিতে ‘ভাল্লিকালচার’ করা হয়। ‘ভাল্লিকালচার’ একটি প্রাচীন মাছ চাষের পদ্ধতি। পার্শে মাছ হল ‘ক্যাটাড্রোমাস ফিস’ অর্থাৎ এটি পরিযায়ী মাছ। সমুদ্রের জোয়ারের জলকে বদ্ধ জায়গায় ভরে নেওয়া হয়। তার মধ্যেই পার্শের মতো বিভিন্ন পরিযায়ী মাছের বাচ্চা চলে আসে। জোয়ারের জল ফিরে যাওয়ার সময় পার্শে মাছের চারা আটকে রেখে তাকেই লালন পালন করে বড় করা হয়। সমুদ্রের জল ঘিরে এই প্রাচীন পদ্ধতির এখনও হয় ইতালিতে। তবে এই পদ্ধতির চাষ আমাদের এখানেও উপকুলবর্তী এলাকায় দেখা যায়।
পিরামিডের দেশ মিশর অনেক প্রাচীন কাল থেকেই পার্শে মাছের স্বাদে রঙিন হয়ে উঠত মধ্যাহ্নভোজ। হ্যাঁ, পার্শে মাছ মিশরের একটি উল্লেখযোগ্য মাছ। প্রাচীন মিশরের সময় থেকে “হোশা” পদ্ধতিতে পার্শে মাছের চাষ করা হয়। ‘হোশা’ একটি স্থানীয় মিশরীয় নাম। এই পদ্ধতিতেও প্রাকৃতিক ভাবে মাছের চারাকে কৃত্রিম ভাবে ঘিরে রেখে আহরন ও চাষ উভয় করা হয়।
ইন্দোনেশিয়া ও হাওয়াইতে “তামবাক” পদ্ধতিতে পার্শে মাছের চাষ করা হয়। ঈষৎ নোনাজলের ধান জমিতে মাছের সাথে ধান চাষের এই পদ্ধতিকেই তামবাক বলে। আর এতেই পার্শে মাছের ব্যাপক চাষ হয়ে আসছে।
উত্তর চীন দেশে ‘হারবর’ পদ্ধতিতে পার্শে মাছের চাষ হয় এবং আমাদের দেশে ভেড়িতে পার্শে মাছের চাষ হয়। ১৯৫৭ সালে ইসরায়েলে কার্পের সাথে পার্শের প্রথম চাষ শুরু হয় এবং ১৯৫৩ সালে ফিলিপাইন্সে মিল্ক ফিসের সাথে পার্শের চাষ শুরু হয়।
আমাদের রাজ্যের মতোই সারা পৃথিবীতে পার্শে মাছের চারা প্রাকৃতিক উৎস্য থেকেই বেশিরভাগ সংগ্রহ করা হয়। তবে আমাদের দেশে জুন, জুলাই ও আগষ্ট মাসে পার্শে মাছের বীজ বা চারা প্রাকৃতিক উৎস্য থেকে জাল দিয়ে সংগ্রহ করা নিষিদ্ধ ।
এবার এই পার্শে মাছের সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া যাক। পার্শে মাছ হল ক্যাটাড্রোমাস ফিস অর্থাৎ এটি পরিযায়ী মাছ। পার্শে মাছ নোনা ও মিষ্টি উভয় জলে বেঁচে থাকতে পারে।
পার্শে মাছের প্রজনন স্বভাব অন্য মাছের চেয়ে কিছুটা বতিক্রমী। প্রাকৃতিক পরিবেশে শীতকালে (নভেম্বর-ফেব্রুয়ারি) এ মাছ অধিক লবণাক্ত জলে প্রজনন করে থাকে। চাষের জন্য চাষীরা প্রাকৃতিক জলাশয় হতে এ মাছের পোনা সংগ্রহ করে থাকে।
এই মাছের হ্যাচারিতে কৃত্রিম প্রজনন করা যায়। ১-২ কেজি পরিনত পুরুষ ও স্ত্রী মাছ নিতে হবে। তবে হ্যাচারিতে কৃত্রিম প্রজননের পূর্বে পার্শে মাছের পোনার ভক্ষণযোগ্য অতিক্ষুদ্র প্রাণীকণার চাষ এবং এই প্রাণীকণার খাদ্য হিসেবে এককোষী উদ্ভিদ চাষ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করা প্রয়োজন। পরিপক্ক পার্শে মাছ অপ্রাণীভোজী হলেও ডিম হতে প্রস্ফুটিত পোনার ডিম্বথলি নিঃশেষ হওয়ার পর পোনার প্রাথমিক খাদ্য হিসাবে অতি ক্ষুদ্র জীবন্ত প্রাণীকণা খেয়ে এরা বড় হয়ে উঠে।
জুভেনাইল পার্শে মাছ যদিও কেবল নোনা জলেই বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু অপরিণত বাচ্চা অবস্থা থেকে ৪-৭ সেন্টিমিটার লম্বা হওয়ার পর থেকে পরিণত মাছ গুলি মিষ্টি ও নোনা উভয় ধরণের জলাশয়ে চাষ করা যায়। পার্শে মাছ মিস্টি জলের পুকুরে খুব ভালো করে চাষ করা যায় । তবে মিষ্টি জলে পরিপক্কতা আসে না, তাই পার্শে মাছের প্রজননের জন্য নোনাজলের প্রয়োজন হয়ে থাকে ।
পরিপক্ক পার্শে মাছ অপ্রাণীভোজী হলেও পোনার প্রাথমিক খাদ্য অতিক্ষুদ্র জীবন্ত প্রাণীকণা।
মাছ গুলি কেবল দিনের বেলায় খাবার গ্রহণ করে। এরা সাধারণত জলাশয়ের প্রাণীকণা, জৈব পদার্থ, তলদেশের কীট প্রভৃতি খাবার খায়।
আরও পড়ুন - গ্রামাঞ্চলে পুকুর পাড়ে শাক-সবজির চাষ থেকে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও কৃষকদের বাড়তি আয়ের সুযোগ
মিশ্র চাষের জন্য পার্শে মাছের সাথে তবে কোন কোন মাছ কি ভাবে চাষ করা যায় ?
কাতলা, কমন কার্প, গ্রাস কার্প, তেলাপিয়া বা আমুর কার্প, মিল্ক ফিস এর সাথে পার্শে মাছের চাষ করা যায়। প্রতি ডেসিম্যালে ১৫ টি ১০-১৫ গ্রাম ওজনের পার্শে মাছের চারাপোনার সাথে ১০টি ১০০ গ্রাম ওজনের কমন কার্প বা আমুর মাছ, ২টি সিলভার কার্প ও ১০-১৫ গ্রাম ওজনের ২৫০ টি তেলাপিয়া মাছ ছাড়া যেতে পারে। পার্শে মাছ ৭-৮ মাস চাষে ১-১.২ কেজি ওজন হয়ে থাকে । তবে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী, আরো কিছুদিন মাছটি রেখে বড় করে বিক্রি করা যেতে পারে।
আবার প্রাকৃতিক উপায়ে জন্মানো পার্শে মাছের পোনা সংগ্রহ করার পর মৎস্যচাষীরা জলাশয়ে ছাড়ার পর চার-পাঁচ মাসের মধ্যে পার্শে মাছের ওজন দাঁড়ায় এক একটির ১৫০-২০০ গ্রাম পর্যন্ত। স্থানীয় বাজারে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। পার্শে মাছের চাষ অত্যন্ত লাভজনক।
আরও পড়ুন - জয়ন্তী রুই – রুই মাছ চাষের এক নতুন প্রজাতি, চাষে দ্বিগুণ লাভবান কৃষক
Share your comments