অনেকসময় বন্যাপ্রবণ বা নিচু জমিতে চাষের খুবই অসুবিধা দেখা যায় | বর্ষাকালে ক্রমাগত বৃষ্টির ফলে চাষীভাইদের খুবই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় | তাই, এই সমস্যা দূর করতে ভাসমান ধাপ পদ্ধতিতে শাক-সব্জি উৎপাদন করা হয় | ফসল উৎপাদনের (Agricultural technique) এটি একটি অসাধারণ নতুন কৌশল। বর্ষার সময় অনেক জায়গায় বেশিরভাগ জমি জলে নিমজ্জিত থাকার ফলে ফসল তথা সব্জি আবাদ করা যায় না। তাই নীচু ও জলমগ্ন এলাকাতে ভাসমান ধাপ পদ্ধতির মাধ্যমে সহজেই শাক-সবজি উৎপাদন (crops production) করা যেতে পারে।
ভাসমান ধাপে সারা বছর ফসল উৎপাদন খুবই লাভজনক, কৃষকরাও অধিক উপার্জন করতে সক্ষম হয় |
ধাপের আয়তন:
প্রতিটি ছোট আকারের ধাপের দৈর্ঘ্য ২০ মিটার, প্রস্থ ২ মিটার ও উচ্চতা ১ মিটার হওয়া উত্তম। প্রতিটি বড় আকারের ধাপের দৈর্ঘ্য ৬০ মিটার, প্রস্থ ২ মিটার ও উচ্চতা ১ মিটার হওয়া প্রয়োজনীয় |
ভাসমান ধাপ তৈরির বিভিন্ন উপকরণ (How to make) :
ভাসমান ধাপ তৈরির প্রধান উপকরণ হচ্ছে- কচুরীপানা। তাছাড়া আমন ধানের খড়, বিভিন্ন ধরনের জলজ উদ্ভিদ যেমন- কুটিপানা, টোপাপানা, কাঁটা শ্যাওলা, লতানো উদ্ভিদ প্রভৃতি ব্যবহৃত হয় । এছাড়াও বাঁশ, নারকেলের ছোবড়ার গুড়া, তুষ, নৌকা প্রভৃতি প্রয়োজন।
ধাপ পদ্ধতিতে ফসল চাষের সময়কাল:
যেসব এলাকা সারা বছর বা বছরের কিছু সময়ে জলাবদ্ধ অবস্থায় থাকে এবং সেসব জলাবদ্ধ স্থানে যদি কচুরীপানা থাকে, তবে শুধুমাত্র সেই কচুরীপানা ব্যবহার করে সারা বছর ধাপ তৈরি করে গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন বা সারা বছর উৎপাদিত হয় এমন সব্জির চারা উৎপাদন করা যায়। সাধারণত মে থেকে জুলাই মাসের মধ্যে পার্শ্ববর্তী নদী, খাল অথবা জলাভুমি থেকে এই কচুরীপানা সংগ্রহ করা হয়। যেসব এলাকায় সারা বছর জলাবদ্ধ থাকে না বা জল থাকে না সেসব এলাকায় স্বাভাবিক নিয়মে মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভাসমান ধাপে মৌসুমি সব্জি চাষ করা যায়।
ধাপ পদ্ধতিতে ফসল চাষের সুবিধা (Benefits):
১. চাষের খরচ অনেক কম হয় |
২. সেচের প্রয়োজন হয়না |
৩. অতিরিক্ত বৃষ্টিতে ফসলের কোনো ক্ষতি হয়না |
৪. স্থায়ী জলাবদ্ধ এলাকায় (খাল, হ্রদ ) সারা বছর এ পদ্ধতিতে সব্জি ও মশলা চাষ করা যায়।
৫. নিচু ও পতিত জলমগ্ন অনাবাদি জমিকে চাষের আওতায় এনে, কর্মসংস্থান হয় |
৬. সারের পরিমানও খুব কম ব্যবহৃত হয় |
যেসব ফসল চাষ করা যায়:
ভাসমান পদ্ধতিতে শাক-সবজি যেমন— লালশাক, পুঁইশাক, শসা, বরবটি, ঢেঁড়স, মিষ্টি কুমড়া, ঝিঙা ইত্যাদি উৎপাদন করা হয়। তবে এর মাধ্যমে লাউ ও লতাজাতীয় সবজি; বিশেষ করে চিচিঙ্গা, ঝিঙা, করলা ও মিষ্টি কুমড়া বেশি উৎপাদন হচ্ছে। কৃষি বিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে আরো নতুন নতুন ফসলকে ভাসমান চাষের আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছেন |
ধাপ কিভাবে তৈরী করা যায়?
একেকটি ভাসমান ধাপ বেড ৫০ থেকে ৬০ মিটার (১৫০ থেকে ১৮০ ফুট) লম্বা ও ১.৫ মিটার (৫ থেকে ৬ ফুট) প্রশস্ত এবং ১ মিটারের কাছাকাছি (২ থেকে ৩ ফুট) পুরু বা উঁচু বীজতলা ধাপ তৈরি করে তার উপর কচুরিপানা এবং পর্যায়ক্রমে শ্যাওলা, টেপাপানা, কুটিপানা, কলমিলতা, জলজলতা স্তরে স্তরে সাজিয়ে নারিকেলের ছোবড়ার গুঁড়া ও ক্ষুদ্রাকৃতির বিভিন্ন ধরনের জলজ উদ্ভিদ পচিয়ে বীজতলার উপর ছড়িয়ে দেয়। সেখানেই বীজ বপন করে উৎপাদন করা হয় বিভিন্ন প্রজাতির শাক আর বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি চাষ করা হয়।
ধাপের পরিচর্যা:
ধাপ তৈরির পর ধাপে জৈব উপকরণ দ্রুত পচাতে ব্যবহার করা হয় সামান্য পরিমাণ ইউরিয়া সার। এ ধাপ চাষের উপযোগী করতে ৭ থেকে ১০ দিন প্রক্রিয়াধীন রাখতে হয়। একটি ধাপের মেয়াদকাল কম বেশি সাধারণত ৩ মাস। ধাপে অঙ্কুরিত চারা পরিপক্ব চারায় পরিণত হয় মাত্র ২০ থেকে ২২ দিনে। যে কারণে পুনরায় ব্যবহার করার জন্য ধাপগুলোর সামান্য পরিবর্তন করতে হয়। এরপর ৫ থেকে ৬ দিন পরপর ভাসমান ধাপের নিচ থেকে টেনে এনে নরম কচুরিপানার মূল বা শ্যাওলা টেনে এনে গোড়ায় বিছিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিদিন ধাপে হালকা করে জল দিতে হবে, যাতে করে চারার গোড়া শুকিয়ে না যায়, সজীব থাকে। আর অল্প পরিমাণ ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে। জৈব সার বেশি ব্যাবহার হওয়ায় কীটনাশকের খরচও কমে |
নিবন্ধ: রায়না ঘোষ
আরও পড়ুন - Drum Seeder: বৃষ্টিতে চাষের জমি নষ্ট হয়ে গেছে ? "ড্রাম সিডার" যন্ত্রের ব্যবহার হবে মুশকিল আসান
Share your comments