বর্তমানে চিকিৎসকরা মাছ, মাংস ইত্যাদি আমিষ জাতীয় খাদ্যের থেকে নিরামিষ খাদ্যগ্রহণের বেশী পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু কেন? কেন খাবেন নিরামিষ? কি উপকার রয়েছে এতে? সত্যই যদি নিরামিষের গুণ জানেন, তাহলে হয়তো আমিষ প্রেমীরাও কাল থেকেই নিরামিষে আস্থা রাখবেন।
সুখী ও স্বাস্থ্যকর জীবন অতিবাহিত করার জন্য নিরামিষ খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। নিরামিষ জাতীয় খাদ্য একপ্রকার সুষম খাদ্য, এর মধ্যে নিহিত থাকে প্রচুর পরিমাণে উদ্ভিজ্জ তন্তু, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, ফলিক অ্যাসিড, ম্যাগনেসিয়াম, সম্পৃক্ত স্নেহপদার্থ, ও প্রচুর পরিমাণে উদ্ভিজ্জ রাসায়নিক পদার্থ। এই কারণে নিরামিষভোজী মানুষের মধ্যে উচ্চ কোলেস্টেরলজনিত, বা নিম্ন রক্তচাপজনিত কোনো রোগ দেখা যায় না এমনকি এইসব মানুষের ক্ষেত্রে হৃদরোগের সম্ভাবনাও অনেক কম হয়। নিরামিষজাতীয় খাদ্য খুব সহজপাচ্য, এবং এইসব খাদ্য রান্না করাও বিশেষ সুবিধাজনক এমনকি অর্থনৈতিক সাশ্রয়তাও প্রদান করে থাকে। এই কারণে নিরামিষ আহার শুধু মাত্র সুস্থ জীবনযাপনের ক্ষেত্রেই নয় বরং পরিবেশের দিক থেকেও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
চলুন জেনে নেওয়া যাক নিরামিষ খাদ্য কেন গ্রহণ করা জরুরী (Benefits of veg food) -
১) দীর্ঘমেয়াদী জীবনকাল (Long-term lifespan) -
আয়ুষ্কালকে দীর্ঘায়িত করার অনেক পদ্ধতি রয়েছে যার মধ্যে নিরামিষ ভোজন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে রয়েছে। আপনি যত বেশি ফল বা সবুজ শাকসবজিকে আপনার নিত্যদিনের খাদ্যতালিকায় রাখবেন আপনার শরীরে তত কম রাসায়নিক ও বিষাক্ত পদার্থের প্রভাব তৈরি হবে। এটাই আপনাকে বহুকাল যাবত সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে সহায়তা করবে।
২) কোলেস্টেরলের পরিমাণ হ্রাস করে (Reduce Cholesterol) -
আপনি বিশ্বাস করুন বা নাই করুন একথা ঠিক যে প্রাণীজ ফ্যাটে আপনার শরীরের কোনো উপকার হয় না। কোলেস্টেরলের প্রায় সবটাই তৈরি হয় প্রাণীজ ফ্যাট থেকে, কারণ উদ্ভিজ্জ ফ্যাটে কোনোরকম কোলেস্টেরল থাকে না। যদিও কোলেস্টেরল মানুষের কোশের জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়, তবুও শুধুমাত্র নিরামিষ খাদ্যের উপর বেঁচে থাকলে শরীরের বিশেষ কোনো ক্ষতি হয় না, কারণ আমাদের শরীর ওই সবুজ শাকসবজি থেকে নিজের প্রয়োজনীয় কোলেস্টেরল যোগার করে নেয়। কোরিয়ান গবেষকগণ তাদের বহু বৎসরের গবেষণার থেকে একথা স্বীকার করেছেন যে সর্বভুক মানুষের তুলনায় নিরামিষাশী মানুষের কোলেস্টেরলের পরিমাণ অনেক কম থাকে ফলে তাদের দেহে স্নেহ পদার্থের মাত্রাও অনেকটাই কম থাকে।
৩) স্থূলত্ব ও হৃদ রোগের ঝুঁকি কমায় (স্থূলত্ব ও হৃদ রোগের ঝুঁকি কমায়) -
নিরামিষভোজী মানুষেরা খুব পরিমিত মাত্রায় নিজেদের পছন্দসই খাদ্য খেয়ে থাকেন, তারা কখনোই বেশি পরিমাণে বা আবেগবশতঃ অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ করেন না, এই সব কারণে নিরামিষভোজী মানুষের দেহে স্থূলত্ব রোগ আগে না। বেলজিয়ামের পেডিয়াট্রিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা মনে করেন নিরামিষ খাদ্য মানুষের ক্ষেত্রে হৃদরোগের আশঙ্কা কমায়।
৪) মধুমেহ রোগের ঝুঁকি কমায় (Reduces the risk of diabetes) -
আমিষভোজী মানুষেরা প্রায়শই রক্তশর্করার সমস্যায় ভোগেন, কখনো কখনো খাদ্যগ্রহণের পরে তা উচ্চপর্যায়ে এই রোগ মাথাচারা দেয়। এই সব আমিষাশী মানুষেরা যদি শাকাহারী হয়ে যায় তাহলে তাদের রক্তে শর্করার পরিমাণ অনেকটাই স্বাভাবিক পর্যায়ে আসে, এর প্রধান কারণই হলো সুষম নিরামিষ খাদ্য মানুষের শরীরে যেমন পুষ্টি যোগায় তেমনি রক্তে শর্করা ও ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ স্বাভাবিক রাখে।
৫) ত্বকের স্বাস্থ্য বজায় রাখে -
আপনি যদি সতেজ ও স্বাস্থ্যকর ত্বক চান তাহলে আপনার উচিত সঠিক ভিটামিন ও খনিজ সমৃদ্ধ খাদ্যগ্রহণ ও প্রচুর পরিমাণে জলপান করুন। ফল ও সবুজ তরকারিতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন, মিনারেলস, এবং যথেষ্ট পরিমাণে অ্যান্টি অক্সিডেন্টস থাকে। এছাড়াও যেহেতু সবজিতে প্রচুর পরিমাণে জলের সম্ভার থাকে, তাই যদি আপনি প্রচুর পরিমাণে নিরামিষ খাদ্য গ্রহণ করেন কাঁচা খান তাহলে আপনার শরীরে এর মধ্যে নিহিত পুষ্টিদ্রব্য গুলি অক্ষত অবস্থায় সরবরাহ হয়ে থাকে। নিরামিষ খাদ্যে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট থাকে যা আপনার ত্বকের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সহায়তা করে।
৬) উচ্চপরিমাণ তন্তুর সমাহার -
ফল ও শাকসবজিতে প্রচুর পরিমাণে তন্তু দেখা যায়, এই উদ্ভিজ্জ তন্তু আমাদের পরিপাক ক্রিয়ায় অনেক সহায়তা করে। শরীরের বিপাক ক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য উদ্ভিজ্জ তন্তু হলো উৎকৃষ্ট উপাদান। এছাড়াও এই সবুজ সবজিতে প্রচুর পরিমাণে জল থাকে যা আমাদের দেহে জলের চাহিদা মেটাতে সাহায্য করে।
৭) মানসিক চাপ কমায় -
গবেষকদের মতে, আমিষাশী মানুষদের তুলনায় নিরামিষাশী মানুষের অনেক বেশি সুখি থাকে। আমিষাশীদের তুলনায় নিরামিষাশীদের মানসিক ও শারীরিক প্রশান্তি অনেকটাই বেশি থাকে এবং তারা অনেকটাই সহজ জীবনযাপন করতে সক্ষম। সতেজ সবজি গ্রহণে শরীর ও মনে অনেক বেশি সতেজটা বজায় থাকে। যদি এই সবজি জৈব উপায়ে উৎপাদন করা হয় তাহলে তা আমাদের শরীরের সতেজতাকে আর বহুগুণ বৃদ্ধি করতে সক্ষম।
৮) বিপাকীয় ক্ষমতা বৃদ্ধি -
নিরামিষ খাবার খুব সহজপাচ্য এবং এটা আমাদের বিপাক ক্রিয়াকে সর্বত্তমভাবে বজায়। নিরামিষভোজী মানুষের ক্ষেত্রে রেস্টিং মেটাবোলিজম রেট অনেক বেশি। আপনি হয়তো এই ব্যাপারটা একটা আমিষ ও নিরামিষভোজী মানুষের মধ্যে যান্ত্রিক গবেষণা চালালে ব্যাপারটি অনেক বেশি পরিষ্কার বুঝতে পারবেন। এই নিরামিষ খাদ্য যে শুধুমাত্র সহজপাচ্য নয়, এটি শারীরিক ফ্যাট বিপাকেও যথেষ্ট সাহায়তা করে।
৯) চোখের ছানি সমস্যার উপশমে সহায়তা করে -
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা অনুসারে, আমাদের খাদ্যাভ্যাস আমাদের চোখের ছানি সমস্যার সৃষ্টির জন্য অনেকটাই দায়ী। দেখা গেছে নিরামিষাশী মানুষদের চোখে ছানি সমস্যার শতকরা পরিমাণ আমিষাশী মানুষদের তুলনায় অনেকটাই কম।
১০) অর্থনৈতিক দিক -
নিরামিষ খাদ্যের মূল্য আমিষ খাদ্যের তুলনায় অনেকটাই কম, তাই নিত্যনৈমিত্তিকভাবে নিরামিষ খদ্য গ্রহণ আমাদের অনেকটাই সাশ্রয় দেয়, অর্থাৎ নিরামিষ খাদ্যগ্রহণের মাধ্যমে আমরা আমাদের পরিশ্রমের অর্থ সাশ্রয় করতে পারি।
আরও পড়ুন - Immunity Increase - করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবেন কীভাবে?
উপসংহারে, এটা বলা যায় নিরামিষ খাদ্য গ্রহণের এমন হাজারো উপকার রয়েছে। অবশ্য এই উপরের আলোচনার মাধ্যমে আমরা আপনাকে আমিষ খাদ্য গ্রহণে নিবারিত করছি না, শুধু একটু সচেতন হতে বলেছি। এখন আপনার ইচ্ছা, আপনি ঠিক কোন দলে থাকবেন।
আরও পড়ুন - Turmeric Milk - হলদি দুধ হোক বা সকালে খালি পেটে হলুদ- বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হলুদ সেবনে
Share your comments