আমাদের পরিচিত ভেষজ উপাদান গুলির মধ্যে মেথি রোগ প্রতিরোধক রূপে অন্যতম। “মেথি” বললেই প্রচুর সুস্বাদু খাবারের নাম আমাদের মনে আসে, মেথির পরোটা থেকে শুরু করে আলু মেথির সবজি- মেথি যেন রান্নায় স্বাদ বর্দ্ধকের কাজ করে! আমাদের অতি প্রিয় পাঁচফোড়নের একটা উপাদান হল এই মেথি।
পুষ্টিগুণ (Nutrients) :
মেথি হল একপ্রকার ভেষজ গাছ যা দক্ষিণ ইউরোপ এবং এশিয়া-এ পাওয়া যায়। এটি দেখতে হলুদাভ খয়েরি রঙের হয়।
মেথি থিয়ামিন, ফলিক এসিড, রিবোফ্লাভিন, নিয়াসিন, ভিটামিন এ, বি৬ , এবং সি তে পরিপূর্ণ। এই ভেষজ নানারকমের প্রয়োজনীয় মিনারেল রয়েছে, যেমন কপার, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, আয়রন, সেলেনিয়াম, জিঙ্ক, ম্যাঙ্গানিজ এবং ম্যাগনেসিয়াম। মেথি গাছের পাতায় প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন কে-এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
মেথির উপকারিতা (Benefits) –
মেথির ব্যবহার শুধুমাত্র রান্নাঘরেই সীমাবদ্ধ নয়- আয়ুর্বেদিক ওষুধ প্রস্তুতিতে এবং রূপ আর চুলের চর্চায় মেথি বহুল পরিমাণে ব্যবহার হয়ে থাকে। জানতে চান কিভাবে এই মেথি আপনার দৈনন্দিন জীবনে কাজে লাগতে পারে? তাহলে জেনে নিন মেথিকে কিভাবে করে তুলতে পারেন আপনার প্রিয় বন্ধু।
স্বাস্থ্যের জন্য মেথির উপকারিতা (Health Benefits) –
১) কোলেস্টেরল -
মেথি শুধুমাত্র রক্তে উপস্থিত কলেস্টেরল থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করে তা নয় আপনার শরীরকেও ধীরে ধীরে কলেস্টেরল থেকে হওয়া ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে ভীষণভাবে সক্ষম।
মেথি শরীরের লিপো প্রোটিন বা ব্যাড প্রোটিন কমাতে সাহায্য করে। মেথির বীজে উপস্থিত স্টেরয়েডাল স্যাপোনিন ক্ষুদ্রান্তে কলেস্টেরল-এর আত্তীকরণের হার কমিয়ে দেয়। এছাড়া লিভার থেকে উৎপন্ন তরলের শোষণের হার কমিয়ে দিতেও কার্যকর। চর্বিযুক্ত খাবার থেকে নির্গত হতে থাকা ট্রিগ্লাইসারাইড-এর শোষণের মাত্রাও মেথি কমিয়ে দিতে সক্ষম।
২) ডায়াবেটিস -
মেথির বীজে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার এবং অন্যান্য উপাদান থাকে যা হজমের ক্ষমতা এবং শরীরের কার্বোহাইড্রেট আর সুগার শোষণ করে নেওয়ার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে। মেথি শরীরে ইন্সুলিন নিঃসরণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় |
বর্তমানে করা রিসার্চ অনুযায়ী প্রতিদিন গরম জলে ভিজিয়ে রাখা ১০ গ্রাম মেথির বীজ ডায়াবিটিস টাইপ ২ নিয়ন্ত্রণ করবার জন্য দারুণ কার্যকর। মেথির গম দিয়ে বানানো রুটি, পাউরুটি টাইপ ২ ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষদের ইনসুলিন প্রতিরোধ করবার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
৩) বাতের ব্যাথা -
বাতের ব্যাথা প্রায় সকল চল্লিশোর্ধ্ব মানুষেরই সমস্যা। ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ-এর প্রতিবেদন অনুসারে মেথির ইস্ট্রোজেনের ওপরে প্রভাব এতটাই বেশি যে বর্তমানে ডাক্তারেরা মেথির ব্যবহারকে ইস্ট্রোজেন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপির সাথে তুলনা করছেন। মেথি বাতের তীব্র ব্যথা বেদনা কমাতে ভীষণভাবে কার্যকর।
৪) হার্টের স্বাস্থ্যরক্ষা -
হার্টের স্বাস্থ্য রক্ষায় মেথির উপকারিতা অপরিসীম। মেথি শরীরে থেকে অ্যাসিডের পরিমাণ খুব দ্রুত কমাতে পারে। শরীরের অ্যাসিডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে এর থেকে কার্যকরী ভেষজ মেলা ভার। মেথির বীজ সারারাত্রি জলে ভিজিয়ে রেখে দিয়ে পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে খেয়ে নিলে হার্টের ব্যাথা বা বুক জ্বালার মতন সমস্যা গুলো ওষুধ না খেয়েই ঘরোয়া পদ্ধতিতে কমে যাবে।
৬) হজমের সমস্যা -
মেথির বীজে প্রচুর ফাইবার এবং অন্যান্য উপাদান থাকে যা কিনা হজমের ক্ষমতা এবং শরীরের কার্বোহাইড্রেট আর সুগার শোষণ করে নেওয়ার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে। মেথিদানা ভিজানো জল প্রোটিন সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে খেলে হজমের সমস্যা ধীরে ধীরে চলে যেতে বাধ্য।
৭) ক্যান্সার প্রতিরোধক -
সাম্প্রতিক কালের একটা গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে মেথির ব্যবহার করবার ফলে ক্যান্সার হবার আশঙ্কা কমেছে। কর্কটরোগ থেকে রক্ষা পেতে ডাক্তারেরা রান্নায় মেথির ব্যবহার করতেও বলছেন। বিশেষ করে মহিলাদের জন্য মেথি রান্নায় অবশ্যই মেশানো উচিৎ কেননা মেথিতে উপস্থিত ট্রাইগ্লিসেরাইড এস্ট্রোজেন গ্রহণকারী মডিউলেটারের কাজ করে এবং ব্রেস্ট ক্যান্সার সৃষ্টিকারী কোষগুলোকে উদ্দীপিত করতে করতে একসময়ে ধ্বংস করে দেয়।
৮) ব্রেস্টের দুধ উৎপাদন -
মেথিতে উপস্থিৎ ডায়োসজেনিন দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি করে | মেথিতে উপস্থিৎ ভিটামিন, মিনারেল মায়ের দুধের পুষ্টিগুণ বাড়িয়ে তা নবজাতকের জন্য অত্যন্ত উৎকৃষ্ট মানের করে তোলে |
৯) ওজন কমাতে মেথি -
মেথি দানা হল লোহা, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, তামা, ভিটামিন বি সিক্স, প্রোটিন, ফাইবার, অনেক উপকারী ভিটামিন এবং খনিজের উৎস। এটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি ফ্লামেটরী বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
মেথি বীজে এক ফাইবার থাকে যা গ্যালাক্টোমান্নান নামে পরিচিত এবং সহজে জলে গুলে যায়, যা ওজন পরিচালনায় এবং আপনাকে পূর্ণ অনুভব করিয়ে খিদের অনভূতিকে প্রশমন করে ওজন হ্রাসে সাহায্য করে। এছাড়াও শরীরের মেটাবলিসম কে বৃদ্ধি করে, যার ফলে মেদ ঝরে যাওয়া এবং অন্য এডিপোশ টিসুর কর্মক্ষমতা হ্রাস পেয়ে যায়।
১০) রক্তচাপ -
মেথির বীজ উচ্চ পটাসিয়াম এবং ফাইবার সামগ্রীর উপস্থিতির কারণে রক্তচাপ হ্রাসের জন্য কার্যকর উপাদান। এক বা দুই চা চামচ মেথি দানা জলের মধ্যে দুই মিনিটের জন্য ফুটিয়ে নিন, সেটি ছেঁকে নিয়ে বীজগুলিকে একটি ব্লেন্ডারের ভিতরে দিয়ে একটি পেস্ট বানান এবং সেটি দিনে দুবার সকালে খালি পেটে খেয়ে নিন। এটি অনুসরণ করলে আপনি দুই থেকে তিন মাসের মধ্যেই উন্নতি লক্ষ্য করবেন।
আরও পড়ুন - Bitter Gourd Juice - শুধু ডায়াবেটিসই নয়, ক্যান্সারকেও প্রতিহত করতে পারে করলা, কি বলছেন বৈজ্ঞানিকরা!
১১) কিডনির কার্যকারিতা -
২০০৭ সালে “ফাইটোথেরাপি রিসার্চ”-এ প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুযায়ী, ক্যালসিয়াম অক্সালেট জাতীয় কিডনির পাথর প্রতিরোধ করতে মেথি সক্ষম। গবেষণার ফলাফলে দেখা গিয়েছে যে মেথি গ্রহণকারী প্রাণীগুলির কিডনিতে উল্লেখযোগ্যভাবে কম ক্যালসিফিকেশন হয়েছে।
Share your comments