ফলের রাজা আম, আর আমের রাজা আলফানসো। স্বাদে-গন্ধে পৃথিবীর এই আম সর্বশ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত। পশ্চিমবঙ্গে এই আমের চাষ মালদা ও মুর্শিদাবাদে বাণিজ্যিকভাবে করা হয়ে থাকে। ভারতের গোয়ায় আলফানসো আমের উৎপত্তি স্থল। কিন্তু মহারাষ্ট্রের রত্নাগিরিতে বর্তমানে সবচেয়ে সেরা জাতের আলফানসোর ফলন হয়। এই জায়গাদুটি ছাড়াও মহারাষ্ট্রের পুনে, গুজরাটের বলসাদ, কর্ণাটকের বেঙ্গালুরু এবং উড়িষ্যার দেবগড়েও সফলভাবে আলফানসো আমের চাষ হয়ে আসছে। আসুন জেনে নেওয়া যাক আলফানসো আম চাষের পদ্ধতি।
আলফানসো আম চাষের পদ্ধতি: (Alfonso Mango cultivation method)
আলফানসো আম চাষের জন্য চাষিভাইদের প্রথমেই মাথায় রাখতে হবে এই বিশেষ প্রজাতির আম চাষের জন্য মাটির অম্লতা প্রয়োজন ৫.৫-৭.০। গভীর, সুনিষ্কাশিত, উর্বর দো-আঁশ মাটি আম চাষের জন্য উপযুক্ত হিসাবে ধরা হয়। বর্ষায় জল দাঁড়ায় না এরকম উঁচু বা মাঝারী উঁচু জমিতে কয়েকবার চাষ ও মই দিয়ে জমি সমতল এবং আগাছামুক্ত করতে হবে। রোপণ দূরত্ব সঠিক হলে এই জাতের আমের ফলন ভালো হবে। এই দূরত্বে গাছ লাগালে এক বিঘা জমিতে প্রায় ৯টি গাছ লাগানো যাবে। বর্গাকার, আয়তাকার, ত্রিভুজাকার বা ষড়ভুজাকার যে কোনও প্রণালীতে চারা লাগানো যাবে। গাছ লাগানোর স্থান চিহ্নিত করে বর্ষাকাল আসার আগেই সেখানে গর্ত করতে হবে। মে-জুন মাস নাগাদ ৭৫-১০০ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতায় গর্ত উচিত। গর্ত করার সময় গর্তের উপরের অর্ধেক অংশের মাটি একপাশে এবং নিচের অংশের মাটি অন্যদিকে রাখতে হবে। গর্ত থেকে মাটি সরানোর পর ১০ দিন পর্যন্ত গর্তটিকে রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। এবার প্রত্যেকটা বানানো গর্তে ১০ কেজি গোবর সার, ২৫০ গ্রাম জিপসাম, ৫০ গাম জিংক সালফেট, ৫০০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম এমপি, ১০ গ্রাম বোরিক এসিড ওপরের দিকের মাটির সঙ্গে মিশিয়ে মাটি ওলোট-পালোট করে গর্ত ভরাট করতে হবে। গর্ত ভরাট করার সময় ওপরের অংশের মাটিতে গর্ত ভরাট না হলে, পাশ থেকে ওপরের মাটি গর্তে দিয়ে দিলে ভালো। মনে রাখতে হবে গর্তের নিচের অংশের মাটি দিয়ে গর্ত ভরাট বিনা করে ভালো।
আলফানসো আমের চারা লাগানোর পদ্ধতি: (How to plant Alfonso Mango seedlings)
সুস্থ-সবল ও রোগমুক্ত চারা রোপণ করলে ভালো ফলন স্বাভাবিক ভাবেই পাওয়া যাবে। রোপণের সময় ৪-৫ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট ২-৩টি ডাল যুক্ত চারা বেছে নিতে হবে। গর্ত ভর্তি করার ১০-১৫ দিন বাদে আবার গর্তের মাটি ভালোভাবে উল্টে পাল্টে নিয়ে গর্তের মাঝখানে চারাটি সোজাভাবে লাগিয়ে দিতে হবে। এরপর চারদিকে মাটি ছড়িয়ে দিয়ে গাছের গোড়া সমান্য চেপে দিতে হবে। চারা বপন করার সময় চারার গোড়ার বলটি যেন না ভাঙে এবং চারা গোড়াটি যাতে বেশি মাটির নিচে ঢুকে না যায় সেদিকে নজর দেওয়া উচিত। রোপণ হয়ে গেলে চারাটি খুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে। বিকেলের দিকে আলফানসো আমের চারা/কলম রোপণ করা সবচাইতে ভালো। রোপণের পর পর বৃষ্টি না নামলে কয়েকদিন সেচ দিয়ে নেওয়া উচিত।
কীটপতঙ্গ ও রোগ ব্যবস্থাপনা:(Pest and disease management)
গাছে নতুন পাতা এলে অনেকসময় পাতাকাটা উইভিল পোকার আক্রমণ হয়। কচি পাতার নিচের দিকে মধ্যশিরার দুই পাশেই স্ত্রী পোকা ডিম দেয়। পরবর্তীকালে স্ত্রী পোকা ডিমপাড়া পাতাটির বোঁটা কেটে নেয়। অবশেষে গাছের সব পাতা পড়ে যায়। ঝরে পড়া কচি পাতা মাটি থেকে সরিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া উচিত। গাছে কচি পাতা আসার ১২ দিন পর লিটারপিছু জলে ২ গ্রাম সেভিন অথবা অন্য যেকোনও কীটনাশক নির্দিষ্ট মাত্রায় স্প্রে করে দিলে এই পোকার আক্রমণ আর থাকে না।
আলফানসো আম বাগানের পরিচর্যা (Alfonso Mango Garden Care)
আলফানসো আম চাষ একটু যত্ন নিয়ে করলেই ফলন অনেকটা বাড়ানো যায়। রোগাক্রান্ত ও মরা ডালপালা মৌসুম আসার পর কেটে নেওয়া উচিত। আলফানসো আম গাছের ডালপালা এমনভাবে ছাটাই করা উচিত যেন গাছের ভেতরেও সূর্যের আলো পৌঁছাতে পারে। গাছের ভেতরের দিকের ডালে ফুল-ফল তেমন হয় না, তাই এই ডালগুলি কেটে দেওয়া উচিত। বর্ষায় কাটা অংশ থেকে নতুন কুশি গজাবে এবং ফুলও আসবে। ডগার বয়স কমপক্ষে ৫-৬ মাস না হলে ওই ডগায় ফুল গজায় না।
আলফানসো আমবাগানে সার প্রয়োগের গুরুত্ব অপরিসীম। গাছপিছু বছরে কতটা করে সার দিতে হবে তা নির্ভর করে মাটির গুণাগুণের উপর। আলফানসো আম গাছে ব্যবহৃত সারের পরিমাণ নিম্নরূপ:
গোবর সার দেওয়া উচিত রোপণের ১ বছর পর ২০, রোপণের ২ বছর পর ২৫, প্রতি বছর বাড়াতে হবে ৫ এবং ২০ বছর ও এর উর্ধ্বে ১২৫ কেজি প্রয়োগ করতে হবে। এভাবে ইউরিয়া রোপণের ১ বছর পর ২৫০, রোপণের ২ বছর পর ৩৭৫, প্রতি বছর বাড়াতে হবে ১২৫ এবং ২০ বছর ও এর উর্ধ্বে ২৭৫০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে। টিএসপি রোপণের ১ বছর পর ১০০, রোপণের ২ বছর পর ২০০, প্রতি বছর বাড়াতে হবে ১০০ এবং ২০ বছর ও এর উর্ধ্বে ২১৫০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে। এমপি রোপণের ১ বছর পর ১০০, রোপণের ২ বছর পর ২০০, প্রতি বছর বাড়াতে হবে ১০০ এবং ২০ বছর ও এর উর্ধ্বে ২১০০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে। জিপসাম রোপণের ১ বছর পর ১০০, রোপণের ২ বছর পর ১৭৫, প্রতিবছর বাড়াতে হবে ৭৫ এবং ২০ বছর ও এর উর্ধ্বে ১৬০০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে। জিংক সালফেট রোপণের ১ বছর পর ১০, রোপণের ২ বছর পর ১৫, প্রতি বছর বাড়াতে হবে ৫ এবং ২০ বছর ও এর উর্ধ্বে ১১০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে। বোরিক এসিড রোপণের ১ বছর পর ৫, রোপণের ২ বছর পর ৭, প্রতি বছর বাড়াতে হবে ২ এবং ২০ বছর ও এর উর্ধ্বে ৫০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে।
সার দু’কিস্তিতে প্রয়োগ করলে তা গাছের পক্ষে ভালো। প্রথম অর্ধেক বর্ষার আগে এবং বাদবাকি বর্ষার পরে দেওয়া উচিত। ভুলবশত প্রথম কিস্তির সার প্রয়োগ না করা হলে তাহলে দ্বিতীয় কিস্তিতে পুরো সার প্রয়োগ করা উচিত। ফলন্ত গাছে গুঁড়ি থেকে ২-৩ মিটার দূরত্বে ৩০ সে.মি. চওড়া ও ১৫-২০ সে.মি. গভীর করে নালা কেটে নিয়ে তার ভেতর রাসায়নিক ও জৈব সার মাটিতে উত্তম ভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। সবথেকে ভালো, দুপুরের দিকে গাছের ছায়া যতটুকু জায়গায় পড়ে ততটুকু অঞ্চলে সার ছিটিয়ে কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। আমগাছে ফল আসার পর গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। এইসময় গাছের প্রয়োজন হয় খাবারের। সার দেওয়া হয়ে গেলে বর্ষার সময় গাছ তার দরকারি খাবার মাটি থেকে নিয়ে নিতে পারে।
আলফানসো আমবাগানে নিয়মিত সেচ দেওয়া প্রয়োজন। মাটিতে রস থাকলে সেচের প্রয়োজন নেই। যদি সেচ দিতেই হয় তাহলে সেচের জায়গাটি কচুরিপানা দিয়ে ঢাকা দিয়ে দিলে মাটিতে অনেকদিন পর্যন্ত রস থাকবে। মনে রাখতে হবে আমগাছে ফুল আসার মাস কয়েক আগে সেচ না দিলেই তা গাছের পক্ষে ভালো। আসলে এই সময় সেচ দিলে গাছে নতুন পাতা বেরোবে এবং মুকুলের পরিমান কমে যাবে এবং তার ফলে ফলনও কম হবে।
আলফানসো আমগাছে কয়েকরকমের পরগাছা দেখতে পাওয়া যায়। ছোট গাছ নয়. বড় গাছেই পরগাছার আক্রমণ অতিরিক্ত হয়। পরগাছার বীজ আমগাছের ডালে বাড়তে থাকে এবং ডাল থেকে দরকারি জল, খাদ্যরস, খনিজ পদার্থ ইত্যাদি শুষে নিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে। পরগাছার শেকড় না থাকায়, শেকড়ের মত এক ধরনের হস্টোরিয়া উৎপন্ন করে ডাল থেকে খাদ্য জোগাড় করে। বর্ষাতেই পরগাছার বীজ বিস্তার নেয়।
Share your comments