বিশ্বজুড়ে বর্তমানে হাইড্রোপনিক্স এর পরিস্থিতি

প্লাস্টিক আবিষ্কার হওয়ার সাথে সাথে বিশ্বজুড়ে হাইড্রোপনিক চাষে একপ্রকার যুগান্তর ঘটে গিয়েছে। প্লাস্টিক ব্যবহারের ফলে নতুন করে ব্যয়বহুল সিমেন্টের বেড ট্যাংক ব্যবহার করতে হয় না। এছাড়াও অত্যাধুনিক পাম্প, স্বয়ংক্রিয় ঘড়ি, অত্যাধুনিক ভালভ এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতির মাধ্যমে পুরো হাইড্রোপনিক সিস্টেম এখন স্বয়ংক্রিয় হয়ে উঠেছে। ইউরোপ এবং আমেরিকার বেশিরভাগ গ্রীনহাউজ গুলিতে এভাবেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে উদ্ভিদ পালন করা হচ্ছে। ২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে গোটা পৃথিবী জুড়ে প্রায় ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে হাইড্রোপনিক মাধ্যমে চাষাবাদ হচ্ছে। আমাদের দেশে অর্থাৎ ভারতে যেসব এলাকায় মাটির গুণগত মান খুবই কম কিন্তু জলের প্রাচুর্য রয়েছে, সেখানে আমরা হাইড্রোপনিক চাষ শুরু করতে পারি। বর্তমানে আমাদের দেশের কিছু বড় শহর যেমন দিল্লি, চন্ডিগড়, নয়ডা এবং ব্যাঙ্গালোরে মানুষেরা বাড়ির ছাদে এবং ব্যালকনিতে হাইড্রোপনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে শাকসবজি এবং মশলা উৎপাদন করছেন। আমাদের দেশেও আগামী দিনে হাইড্রোপনিক চাষের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে

KJ Staff
KJ Staff

মাটি ছাড়া কি আদৌ চাষ সম্ভব? -এই প্রশ্নটা আমাদের অনেকের মনেই এসেছে। ‘হাইড্রোপনিক্স’ শব্দভাণ্ডারে একটি নবতম সংযোজন হলেও, এই পদ্ধতির সাথে অনেক পুরনো দিনের যোগাযোগ রয়েছে। যেমন ধরুন, ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান অথবা মেক্সিকো আজটেক-এর ভাসমান বাগান, এগুলো সবই উৎকৃষ্ট হাইড্রোপনিক্স এর উদাহরণ। এরপর ধীরে ধীরে আমাদের বিজ্ঞান এবং গবেষণা এগিয়ে চলল, দেখা গেল গাছকে শুধুমাত্র একটি পরিপোষক সমৃদ্ধ তরলের মধ্যে রেখে দিলেই তাকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। তারপরে ধীরে ধীরে গাছের পুষ্টির জন্য আবশ্যকীয় খনিজ পরিপোষক পদার্থের আবিষ্কার হতে থাকলো। গাছেদের প্রয়োজনীয়তার উপর নির্ভর করে, 'মাইক্রো এলিমেন্ট অথবা মূল খনিজ' এবং খনিজ পদার্থ যেগুলি স্বল্প পরিমাণে প্রয়োজন হয়' তেমনভাবে শ্রেণীবিভাগ করা হলো।

১৯৩০ দশকের শুরুর দিকে, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার একজন বিজ্ঞানী, প্রফেসর উইলিয়াম গেরিকে সর্বপ্রথম বাণিজ্যিকভাবে শুধুমাত্র খনিজ পদার্থ সমৃদ্ধ তরলের মধ্যে গাছ চাষ করা শুরু করেন, তিনিই প্রথম পদ্ধতিটির নামকরণ করেন‘হাইড্রোপনিক্স’। দুটি গ্রিক শব্দ 'হাইড্রো' যার অর্থ জল এবং 'পনিক্স' যার অর্থ কার্য, এর সমন্বয়ে তৈরি। অর্থাৎ, হাইড্রোপনিক্স হলো এমন একটি বৈজ্ঞানিক চাষ পদ্ধতি যেখানে উদ্ভিদ কে পুরোপুরি মাটি ছাড়া, কিন্তু কিছু জড়পদার্থ যেমন, নুড়ি পাথর, বালি, পিট মস, ভার্মি কুলাইট, পারলাইট, নারকেলের ছোবড়া গুঁড়ো (কোকো-পিট), কাঠের গুঁড়ো, এবং ধানের তুষ সহযোগে একটি উৎকৃষ্ট খনিজ পদার্থ সমৃদ্ধ দ্রবণ অথবা নিউট্রিয়েন্ট এর মধ্যে রাখা হয়, যা উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে সাহায্য করে।

প্লাস্টিক আবিষ্কার হওয়ার সাথে সাথে বিশ্বজুড়ে হাইড্রোপনিক চাষে একপ্রকার যুগান্তর ঘটে গিয়েছে। প্লাস্টিক ব্যবহারের ফলে নতুন করে ব্যয়বহুল সিমেন্টের বেড ট্যাংক ব্যবহার করতে হয় না। এছাড়াও অত্যাধুনিক পাম্প, স্বয়ংক্রিয় ঘড়ি, অত্যাধুনিক ভালভ এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতির মাধ্যমে পুরো হাইড্রোপনিক সিস্টেম এখন স্বয়ংক্রিয় হয়ে উঠেছে। ইউরোপ এবং আমেরিকার বেশিরভাগ গ্রীনহাউজ গুলিতে এভাবেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে উদ্ভিদ পালন করা হচ্ছে। ২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে গোটা পৃথিবী জুড়ে প্রায় ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে হাইড্রোপনিক মাধ্যমে চাষাবাদ হচ্ছে। প্রধানত আমেরিকা, কানাডা, মেক্সিকো, স্পেন, ইটালি, ফ্রান্স এবং ইজরায়েলের মোট চাষযোগ্য জমির একটা বড় অংশে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষ হচ্ছে। তবে এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ইউরোপের নেদারল্যান্ডসের বেশ কিছু ব্যাক্তিগত অত্যাধুনিক গ্রিনহাউসে, (নেদারল্যান্ডে প্রায় ৪৬০০ হেক্টর জমিতে) হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে সবজি চাষ করা হচ্ছে। এই গ্রিনহাউস গুলির ভেতরে প্রতিটি কাজ অত্যন্ত উন্নত প্রযুক্তির সেন্সর এবং কেন্দ্রীয় কম্পিউটার কন্ট্রোল সিস্টেম এর মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। মেক্সিকো এবং মধ্যপ্রাচ্যের শুষ্ক মরুভূমি অঞ্চলে সমুদ্রের জল কে লবণ মুক্ত করে হাইড্রোপনিক এর কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।

ক্রেতা হাইড্রোপনিক ফসলের উচ্চ গুণগত মান সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হওয়ার সাথে সাথেই বাজারে এর বিস্তার লাভ ঘটছে। প্রথম থেকেই হাইড্রোপনিক্স এর ক্ষেত্রে সব থেকে বড় বাজার ইউরোপ। এছাড়াও ধীরে ধীরে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে হাইড্রোপনিক এর বাজার বাড়ছে। এক্ষেত্রে, নেতৃত্ব স্থানীয় দেশ গুলি হল নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ইজরায়েল, কানাডা এবং আমেরিকা। বাণিজ্যিক হাইড্রোপনিক এর ক্ষেত্রে গোটা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে নেদারল্যান্ড। এদেশের প্রায় ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে টমেটো, ক্যাপসিকাম, শসা এবং ফুল চাষ করা হয়। অস্ট্রেলিয়া প্রতিবছর প্রায় ৩০০-৪০০ মিলিয়ন ডলার হাইড্রোপনিক ফসল উৎপাদন করে, যা তাদের মোট উৎপাদনের প্রায় কুড়ি শতাংশ। অস্ট্রেলিয়া গোটা পৃথিবীর মধ্যে সবথেকে বেশি পরিমাণ হাইড্রোপনিক লেটুস উৎপাদন করে। এছাড়াও তারা যে পরিমাণ হাইড্রোপনিক স্ট্রবেরি তৈরি করে, তা আমেরিকার থেকেও অনেক বেশি। কানাডা এবং স্পেন ধীরে ধীরে নিজেদের হাইড্রোপনিক ফার্মের এলাকা বাড়িয়ে চলেছে। এমনকি, জাপানে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ধান চাষ শুরু হয়েছে। ইজরায়েলে শুকনো মরু এলাকায় হাইড্রোপনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে অনেক ধরণের বেরি, লেবু এবং কলা উৎপাদনের চেষ্টা চলছে।

মাটি ছাড়া চাষ (Soil-less cultivation) পদ্ধতির মাধ্যমে আমরা সাফল্যের সাথে পরিবেশবান্ধব এবং পুষ্টিকর ফসল পেতে পারি। ২০১৬ সালের হিসেব অনুসারে গোটা বিশ্বে হাইড্রোপনিক বাজারের মূল্য প্রায় ২১,২০৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছুঁয়েছে। আমাদের দেশে অর্থাৎ ভারতে যেসব এলাকায় মাটির গুণগত মান খুবই কম কিন্তু জলের প্রাচুর্য রয়েছে, সেখানে আমরা হাইড্রোপনিক চাষ শুরু করতে পারি। বর্তমানে আমাদের দেশের কিছু বড় শহর যেমন দিল্লি, চন্ডিগড়, নয়ডা এবং ব্যাঙ্গালোরে মানুষেরা বাড়ির ছাদে এবং ব্যালকনিতে হাইড্রোপনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে শাকসবজি এবং মশলা উৎপাদন করছেন। মুম্বাই সহ কিছু বড় শহরে কেন্দ্রস্থলে ঘরের ভেতর এই পদ্ধতি ব্যবহার করে বিষমুক্ত শাকসবজি ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছেন বেশ কিছু যুবক-যুবতি। আমাদের দেশেও আগামী দিনে হাইড্রোপনিক চাষের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। অনেকেই নিজেদের লোভনীয় চাকরি ছেড়ে বেরিয়ে এসে হাইড্রোপনিক চাষের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করছেন এবং বাণিজ্যিক আকারে নিজেদের ব্যাবসা শুরু করেছে। 

স্বপ্নম সেন (swapnam@krishijagran.com)

তথ্যসূত্র - আরজু আলী খাঁন

Published On: 23 March 2020, 03:17 PM English Summary: Current hydroponics situation around the world

Like this article?

Hey! I am KJ Staff. Did you liked this article and have suggestions to improve this article? Mail me your suggestions and feedback.

Share your comments

আমাদের নিউজলেটার অপশনটি সাবস্ক্রাইব করুন আর আপনার আগ্রহের বিষয়গুলি বেছে নিন। আমরা আপনার পছন্দ অনুসারে খবর এবং সর্বশেষ আপডেটগুলি প্রেরণ করব।

Subscribe Newsletters