লঙ্কা/মরিচ একটি অর্থকরী ফসল৷ এর চাষে কৃষকেরা প্রচুর লাভও করতে পারেন৷ লংকাতে ভিটামিন এ, সি ছাড়াও আরও বহু ধরণের উপাদান বিদ্যমান যা আমাদের শরীরের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়৷ তাই রান্নাতে, মশলা বা আচার তৈরিতে লঙ্কা ছাড়া অনেকে ভাবতেই পারেন না৷
যদি উন্নত মানের লঙ্কা চাষ করা হয়, তাহলে তার প্রভাব ফলনে পড়বে৷ সঠিকভাবে চাষ করতে পারলে লাভ নিশ্চিত৷ অর্থাৎ, উন্নত মানের লঙ্কার পাশাপাশি জলবায়ু, মাটি, সার, পরিচর্যা সবকিছু সঠিক হতে হবে, তবেই এই চাষে কৃষক লাভের মুখ দেখবেন।
জেনে নিন লঙ্কা চাষ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য -
লংকা সাধারণত উষ্ণ-আর্দ্র জলবায়ু পছন্দ করে, যদিও ফল পাকার সময় শুষ্ক আবহাওয়াই আদর্শ। ৭৫-১০০ সেমি বার্ষিক বৃষ্টিপাত আদর্শ, যদিও বৃদ্ধির সময় অতিরিক্তি বৃষ্টিপাত পাতাঝরা এবং গাছ পচার মত বিপদ ডেকে আনে। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২০-৩০ ডিগ্রি সে: ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সে: হওয়া বাঞ্ছনীয়। গ্রীষ্মকালে অধিক তাপমাত্রায় ফুল-ফল ঝরে যায়।
মাটি:
নিকাশি ব্যবস্থাযুক্ত বেলে-দোঁয়াশ মাটি লংকা চাষের জন্য উপযুক্ত। মাটিতে অক্সিজেনের অভাব গাছের বৃদ্ধির জন্য হানিকারক। মাটির অম্লতা ৫.৫- ৬.৮ হওয়া বাঞ্চনীয়। লংকা আম্লিক মাটির প্রতি সংবেদনশীল।
রপ্তানিযোগ্য জাত:
কাশি আর্লি, সি.এইচ-১, সি.এইচ-৩, অর্ক মেঘনা, অর্ক শ্বেতা, অর্ক হরিতা, কাশি অনমল, পুসা সদাবাহার, পাঞ্জাব লাল, অর্ক লোহিত, আজাদ মির্চ-১, ভাগ্যলক্ষ্মী, ফুলে সূর্যমুখী, ভাস্কর।
বীজতলা তৈরী:
বীজতলার মাটিকে বারবার কুপিয়ে ঝুরঝুরে করে বীজতলাটি জমি থেকে ১৫সেমি উঁচুতে এবং এক মিটার চওড়া করে বানানো উচিত। ভালোভাবে পচানো গোবর সার বা কম্পোস্ট সার প্রতি বর্গমিটারে ৩-৪ কেজি হিসাবে প্রয়োগ করে মাটিতে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। ৪.০% ফরমালডিহাইড বা ২-৩ গ্রাম ক্যাপটান প্রতি লিটার জলে গুলে বীজতলা শোধন করে, ৭-১০ দিনের জন্য পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা উচিত।
বীজের হার:
এক হেক্টর জমি চাষের জন্য সাধারণ জাতের ক্ষেত্রে ৫০০-৬০০ গ্রাম এবং হাইব্রিডের ক্ষেত্রে ২৫০-৩০০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন।
বীজ শোধন:
বীজ বপনের পূর্বে বীজকে ক্যাপটান বা থাইরাম প্রতি কেজি বীজে ২-৩ গ্রাম মিশিয়ে শোধন করা প্রয়োজন।
বীজ বপন:
বীজকে মাটির নীচে ৫ সেমি গভীরে লাইন করে রোপন করে তার উপর পাতাপচা সারের স্তর বিছিয়ে বীজতলা শুকনো খড় বা লম্বা ঘাস দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। প্রতিকূল আবহাওয়া যেমন প্রখর রৌদ্র ও অতি বৃষ্টিতে বীজতলাটি দু-পাশ খোলা পলিটানেলের মধ্যে করা উচিত। চারাগুলো যেন পর্যাপ্ত অথচ সরাসরি তীব্র সূর্যালোক না পায় তার জন্য ছায়ার ব্যবস্থা করতে হবে। বীজতলার চারা বেরোনোর ১০-১২ দিনের মাথায় চারা ঘন হলে তাকে পাতলা করতে হবে। প্রয়োজনমত প্রতিদিন বীজতলায় জল দিতে হবে। চারাকে শক্তপোক্ত করার জন্য জমিতে চারা রোপনের ৪-৬ দিন আগে বীজতলায় জল দেওয়া বন্ধ করতে হবে। ৩৫-৪০ দিন বয়সি পুষ্ট ও নীরোগ চারা মূল জমিতে রোপনের উপযোগী। বীজতলার মাটি ভালোভাবে ভিজিয়ে চারা তোলা উচিত যাতে শিকড়ের কোন ক্ষতি না হয়।
বীজ বপনের সময়:
১) মে- জুলাই: শরৎ ও শীতকালীন ফসলের জন্য
২) সেপ্টেম্বর- অক্টোবর: শীত ও প্রাক গ্রীষ্মকালীন ফসলের জন্য।
৩) জানুয়ারি- ফেব্রুয়ারি: গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালীন ফসলের জন্য
৪) ফেব্রুয়ারি- এপ্রিল: পার্বত্য অঞ্চলের জন্য
সারপ্রয়োগ (Fertilizer application) -
হেক্টর প্রতি ৪-৬ টন কেঁচো সার জমিতে শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করা যেতে পারে। সাধারণ জাতের ক্ষেত্রে নাইট্রোজেন: ফসফরাস: পটাশ ঘটিত সার ১০০:৬০:৪০ কেজি ও হাইব্রিডের ক্ষেত্রে নাইট্রোজেন: ফসফরাস: পটাশ ঘটিত সার ১৫০:৮০:৮০ কেজি। এক তৃতীয়াংশ নাইট্রোজেন ঘটিত সার এবং পুরো ফসফরাস ও পটাশ ঘটিত সার জমিতে শেষ চাষ দেওয়ার সময় দিতে হবে। বাকি নাইট্রোজেন ঘটিত সার সমান দুভাগে ভাগ করে ৩০ দিন অন্তর চাপান সার হিসাবে প্রয়োগ করতে হবে।
রোগ-পোকা ও তার নিয়ন্ত্রণ (Disease & pest management) -
মুখ্য পোকা-মাকড়:
১) হলদে মাকড়: ছোট ও পূর্ণাঙ্গ উভয় মাকড়ই পাতা থেকে রস চুষে খেয়ে নেয় ফলে পাতা নিচের দিকে মুড়ে যায় এবং উল্টানো নৌকার আকৃতি ধারণ করে।
প্রতিকার: বিউপ্রফেজিন ২৫ এস.সি. @ ১.২ মিলি/লি অথবা ক্লোরফেনপাইরি ১০ এস.সি @ ২ মিলি/লি অথবা ডায়াফেনথিউরোন ৫ ডব্লিউ.পি. @ ১.২ গ্রা/লি অথবা ডাইমিথোয়েট ৩০ ই.সি. @২ মিলি/লি ১০-১৫ দিন অন্তর পর্যায়ক্রমে পাতায় স্প্রে করতে হবে।
২) থ্রিপস বা চুষি পোকা: পাতা ও গাছের কচি অংশ থেকে রস চুষে খেয়ে নেয়, আক্রান্ত পাতা ছোট হয়ে, কুঁকড়ে উপরের দিকে মুড়ে যায় এবং শেষমেষ ঝরে পড়ে।
প্রতিকার: ইমিডাক্লোপ্রিড ৭০ ডব্লিউ.এস @ ৫-১০ গ্রা/কেজি দিয়ে বীজ শোধন করতে হবে। মাঠে নীল আঠালো ফাঁদ পাততে হবে, সেক্ষত্রে একর প্রতি ৮০-১০০ টা ফাঁদ প্রয়োজন। এসিটামেপ্রিড ২০ এস.সি. @ ০.২ মিলি/লি অথবা কার্বফিউরন ৩জি @ ৩৩.৩ কেজি/হে অথবা ডাইমিথয়েট ৩০ ই.সি. @ ১.৫ মিলি/লি অথবা ইথিওন ৫ ই.সি.@ ৩-৪ মিলি/লি অথবা থায়োক্লোপ্রিড ২১.৭ এস.সি.@ ০.৬ মিলি/লি ১০-১৫ দিন অন্তর পর্যায়ক্রমে পাতায় স্প্রে করতে হবে।
৩) সাদামাছি: ছোট ও পূর্ণাঙ্গ উভয় মাছিই গাছের রস খায় এবং গাছের বৃদ্ধিতে বাধা দেয়। চরম পর্যায়ে গাছের পাতা হলুদ হয়ে ঝরে পড়ে যায়। এরা লংকার পাতা কুঁকড়ে যাওয়ার ভাইরাসের বাহক হিসাবে কাজ করে।
প্রতিকার: ইমিডাক্লোপ্রিড ৭০ ডব্লিউ.এস @ ৩-৫ গ্রা/কেজি দিয়ে বীজ শোধন করতে হবে। মাঠে হলুদ আঠালো ফাঁদ পাততে হবে, সেক্ষত্রে একর প্রতি ৮০-১০০ টা ফাঁদ প্রয়োজন। চারাগাছকে বীজতলায় ৪০-৬০ মেসের মশারির আচ্ছাদনে লাগাতে হবে। নিমযুক্ত কীটনাশক যেমন সায়ানট্রানিলিপ্রল ১০ ও.ডি. @ ১.২ মিলি/লি অথবা ইমিডাক্লোপ্রিড ১৭.৮ এস.এল @ ০.৩৫ মিলি/লি অথবা কার্বোসালফান ২৫ ই.সি.@ ২ মিলি/লি ১০-১৫ দিন অন্তর পর্যায়ক্রমে পাতায় স্প্রে করতে হবে।
মুখ্য রোগ:
১) ফলপচা ও ডগা শুকনো:
কচি ডগা ও নরম পাতা কালো হয়ে শুকিয়ে যায়। পচন উপর থেকে নিচে নামে। ছালের উপর লম্বাটে কালচে দাগ পড়ে। পাকা ফলের উপর কালো দাগ হয়। ছত্রাক মূলত বীজবাহিত।
প্রতিকার: রোগমুক্ত ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। ০.২৫% কার্বেন্ডাজিম দিয়ে বীজ শোধন করতে হবে। টেবুকোনাজল ২৫% ডব্লিউ.জি @০.৫-০.৭৫ কেজি/হে অথবা কপার সালফেট ২.৬৭% এস.সি. ১.০ লি/হে স্প্রে করতে হবে।
২) চারা ঢলে পড়া:
কচি চারা মাটির ওপরে আসার আগে মারা যায়। আবার জন্মানো চারার মাটি সংলগ্ন গোড়ায় জলে ভেজা বাদামি দাগ দেখা যায় এবং চারার রং হালকা সবুজ হয়।
প্রতিকার: প্রতি কেজি বীজের সঙ্গে ৩ গ্রাম থাইরাম বা ৪ গ্রাম ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি মিশিয়ে শোধন করতে হবে। ফসলের অবশিষ্ট অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে। শস্য চক্র অনুসরণ করতে হবে।
৩) পাতা কোঁকড়ানো:
গাছের পাতা কুঁকড়ে গাছ ছোট হয়ে যায়। গাছে ফুল ফল কম ধরে। সাদামাছি এই রোগের বাহক।
প্রতিকার: সাদামাছি দমন করলে এই রোগ থেকে কিছুটা প্রতিকার পাওয়া যায়। ইমিডাক্লোপ্রিড ৭০ ডব্লিউ.এস @ ৩-৫ গ্রা/কেজি দিয়ে বীজ শোধন করতে হবে। মাঠে হলুদ আঠালো ফাঁদ পাততে হবে, সেক্ষত্রে একর প্রতি ৮০-১০০ টা ফাঁদ প্রয়োজন। চারাগাছকে বীজতলায় ৪০-৬০ মেসের মশারির আচ্ছাদনে লাগাতে হবে। ভুট্টাকে সীমান্ত ফসল হিসাবে ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
ফসল তোলা ও ফলন -
৬০-৭০দিন বয়সের গাছ থেকে সাধারণত কাঁচা লংকা তোলা হয়ে থাকে। ফল পাকতে শুরু করলে এক থেকে দু'সপ্তাহ পর পর পাকা লংকা তোলা হয়। হেক্টর প্রতি কাঁচা লংকার গড় ফলন সাধারণ জাতের ক্ষেত্রে ৭-১০ টন এবং হাইব্রিডের ক্ষেত্রে ১২-১৫ টন।
ড. শুভ্রমাল্য দত্ত (বরিষ্ঠ গবেষক, সবজি বিজ্ঞান বিভাগ, উদ্যানবিদ্যা অনুষদ, বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়)
Image source - Google
Related link - (Pest management of eggplant) বেগুন ফসলকে কীটশত্রুর হাত থেকে কীভাবে রক্ষা করবেন? রইল সমাধান
কৃষি মন্ত্রক থেকে জারি সতর্কতা, ভুট্টার ফল আর্মি ওয়ার্ম (FAW) প্রতিরোধের উপায়
Share your comments