গ্রীষ্মকালীন সবজী ও ফল, প্রধানত করলা, লাউ, কুমড়ো, চিচিঙ্গা, ঝিঙে, পটল, শসা, কাঁকরোল, কুদরী, আম, পেয়ারা, লেবু ইত্যাদি, বিভিন্ন প্রজাতির ফলের মাছির আক্রমণে উল্লেখযোগ্য হারে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এরা বহুভোজী এবং সারা বিশ্বব্যাপী কৃষককুলের কাছে একটি মারাত্মক সমস্যা। প্রায় ৫০% পর্যন্ত ফসল এদের দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই কৃষক ভাইয়েরা ফলের মাছির সংক্রমণে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়েন। এ বিষয়ে আপনাদেরকে অবগত করার উদ্দেশ্যে এই ছোট্ট প্রতিবেদনটির উপস্থাপনা। আশা করি, পাঠককুল উপকৃত হবেন এই প্রতিবেদনটি পড়ে। পূর্ণাঙ্গ ফলের মাছি (ফ্রুট ফ্লাই) ৪-৭ মিমি লম্বা, সরু, হাল্কা বাদামী রঙের ও স্বচ্ছ ডানাযুক্ত। স্ত্রী মাছি নরম ফলের ত্বকের নীচে ২-৪ মিমি গর্তের মধ্যে একক ভাবে বা গুচ্ছাকারে ৪-১০ টি ডিম পাড়ে। ম্যাগট (অপূর্ণাঙ্গ কীড়া) ২-৭ দিনে ডিম ফুটে বেরিয়ে ফলের ভিতরে ঢুকে নরম শাঁস ও বীজ খায়।
আক্রান্ত ফলের ত্বকে সোনালি রস ছোট্ট পুঁতির আকারে জমাট বেঁধে থাকে, যা দেখে সহজেই পোকার আক্রমণের (Insect Attack) ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়। আক্রান্ত ফলের উপর চাপা, বিবর্ণ ও বিকৃত দাগ সৃষ্টি হয়। এরূপ ফল খাওয়ার অনুপযুক্ত। অচিরেই আক্রান্ত ফল ছত্রাক ও ব্যাক্টিরিয়ার সংক্রমণে পচে যায়। অনেক সময় আক্রান্ত ফল অপরিণত অবস্থায় ঝরে পড়ে। পূর্ণবর্ধিত ম্যাগট ৯-১০ মিমি লম্বা, ২ মিমি চওড়া ও সাদা রঙের হয়। ফল থেকে বেরিয়ে পূর্ণগঠিত ম্যাগট মাটির ১.৫ – ১৫ সেমি গভীরে পুত্তলীতে রূপান্তরিত হয়। গ্রীষ্মকালে ও শীতকালে লার্ভা ও পুত্তলী দশা যথাক্রমে ৩ এবং ৫-৯ দিনে ও ৩ সপ্তাহ এবং ৪ সপ্তাহে সম্পূর্ণ করে। আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে প্রায় ১২-৩৪ দিনে একটি জীবনচক্র সম্পন্ন করে। পূর্ণাঙ্গ ফলের মাছি সারা বছর তৎপর থাকলেও গ্রীষ্মকালে এদের আক্রমণ বেশি হয়। শীতকালে পূর্ণাঙ্গ মাছি শীতঘুম সম্পন্ন করে।
প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা হিসাবে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গুলি নিতে হবে (Control Method)–
-
যান্ত্রিক ও পরিচর্যামূলক ব্যবস্থা হিসাবে গ্রীষ্মকালে জমিতে চাষ দিয়ে পুত্তলী নষ্ট করে ফেলতে হবে। ফলের বাগানে গাছের মধ্যের ফাঁকা স্থানের মাটি নিয়মিত অন্তর্বর্তী কর্ষণের মাধ্যমে পোকার পুত্তলী নষ্ট করে মাছির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
-
আক্রান্ত ফল গাছ থেকে সংগ্রহ করে মূল জমি থেকে দূরে মাটির প্রায় ২ ফুট গভীরে পুতে নষ্ট করে ফেলতে হবে।
-
গাছে ফল ধরার পর কাগজ বা পলিথিন ব্যাগ বা ফ্রুট ব্যাগ (Brand: HORTIVISION, Fruit TECH) দিয়ে ঢেকে দিলে সুফল মেলে।
-
একর প্রতি ৮-১০ টি ফ্রুট ফ্লাই ফেরোমন ট্র্যাপ মাটি থেকে ৫ ফুট উপরে খুঁটির সাথে (ফলের গাছের ক্ষেত্রে ডালে) স্থাপন করে পুরুষ মাছি আকর্ষণ ও নিধনের ব্যবস্থা করলে সুফল পাওয়া যায়।
-
নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা - নিমঘটিত কীটনাশক (নিমাজল, ইকোনিম প্লাস ইত্যাদি) ২.৫-৩ মিলি বা পাইরিথ্রাম ২% এক্সট্রাক্ট ২ মিলি প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে ৭ দিন অন্তর গাছে ফুল আসার পর সাবধানতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে সন্ধ্যের পর স্প্রে করলে সুফল মেলে। এক একর ফসলে স্প্রে করতে ২০০ লিটার জল প্রয়োজন।
-
কীটনাশকের ব্যবহার - সন্ধ্যের পর সায়ান্ট্রানিলিপ্রোল ১০.২৬% ওডি (সায়াজিপায়র, বেনেভিয়া) ১.৮ মিলি বা ডেল্টামেথ্রিন ২.৮% ইসি (ডেসিস, রাভেন) ১ মিলি বা সাইপারমেথ্রিন ২৫% ইসি (সিম্বুশ, টাটা সাইপার) ১ মিলি বা স্পাইনোস্যাড ৪৫% এসসি (ট্রেসার, স্পিন্টার, কণসার্ভ) ০.৩ মিলি প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে ১৫ দিন অন্তর ৩-৫ টি স্প্রে করলে ভাল ফল পাওয়া যায়। স্প্রে করার আগে ব্যবহারযোগ্য ফল তুলে নিতে হবে। একই কীটনাশক বারবার না দিয়ে বদলে ব্যবহার করুন।
আরও পড়ুন - জানুন সঠিক উপায়ে ওলকচু চাষ করার পদ্ধতি
-
বিষ টোপের ব্যবহার - এক লিটার জলে ৪০০ গ্রাম গুড়, ১০ মিলি ম্যালাথিয়ন ৫০% ইসি (ম্যালাথিয়ন, সাইথিয়ন) বা ২.৫ মিলি স্পাইনোস্যাড ৪৫% এসসি বা ১০ মিলি অ্যাবামেক্টিন ১.৯% ইসি (অ্যাবাসিন) ও ১০ গ্রাম ইষ্ট হাইড্রোলাইসেট মিশিয়ে বড় বড় ফোঁটার আকারে গাছের উপর স্প্রে করলে কিংবা চওড়া মুখ ওয়ালা পাত্রে নিয়ে গাছের ডালে বা মাটি থেকে ৫ ফুট উপরে স্থাপন করলে পূর্ণাঙ্গ মাছির নিধন করা যায়। কাটা ফলের উপর ঐ দ্রবণ লাগিয়ে ছাউনিযুক্ত জায়গায় প্লেটের উপর রেখে পূর্ণাঙ্গ মাছি দমন করা সম্ভব।
ফলের মাছির সুসংহত নিয়ন্ত্রণ উল্লিখিত পদ্ধতিগুলি একটি এলাকার সমস্ত কৃষক ভাইদের সম্মিলিতভাবে পালনের মাধ্যমে সম্ভবপর।
আরও পড়ুন - সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জলপাই চাষ
Share your comments