বর্তমানে আমাদের রাজ্যে তথা পূর্ব ভারতের বেশ কিছু রাজ্যে নারিকেল চাষের ক্ষেত্রে একটি নবতম সংযোজন হল একটি নতুন প্রজাতির সাদা মাছি।
প্রায় সব সবজিতেই কম বেশি সাদা মাছির প্রকোপ দেখা যায়। প্রতিবছর এই সাদা মাছির প্রকোপে সবজি চাষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। কিন্তু সাদামাছির এই নতুন প্রজাতির আগমন দেশজুড়ে কৃষিমহল তথা কৃষি বৈজ্ঞানিকদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইংরেজিতে এই সাদা মাছিকে ‘Rugose Spiralling Whitefly’ অথবা সংক্ষেপে ‘আরএসডব্লিউ (RSW)’ (বিজ্ঞানসম্মত নাম: Aleurodicus rugioperculatus Martin) বলা হয়। বাংলায় একে সাধারণভাবে 'নারকেলের সাদা মাছি' বলতেই পারেন। যেহেতু, এই প্রজাতিটি বিজ্ঞান মহলের কাছে বেশ নতুন, তার ফলে এদের সম্বন্ধে খুব বেশি তথ্য এখনো পর্যন্ত জানা যায়নি। উত্তর আমেরিকার বেশ কিছু কীট বিশেষজ্ঞ এদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং অন্যান্য বিষয়ের উপর জানার জন্যে নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সনাক্তকরণ:
‘হেমিপটেরা’ পর্বের এই মাছির সাথে শ্রেণীবিন্যাস গত ভাবে ‘দয়ে পোকা (Mealy Bug)’ এবং ‘জাব পোকা (Aphid)’ এর মিল রয়েছে। এই মাছিও গাছের পাতার নিম্নভাগের রস শুষে খেয়ে থাকে। ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা গবেষণা করে দেখেছেন, ২৭° সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় এই মাছি ৩০ দিনের মধ্যে নিজেদের জীবনচক্র সম্পন্ন করে ফেলে। এদের পলিফেগাস প্রবৃত্তির জন্যে এরা প্রায় যেকোনো ধরনের ফসলের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে পারে। তাই দক্ষিণভারতে প্রথম দেখা যাওয়ার পর থেকে খুব দ্রুত এরা বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। উপরন্তু, খুব সহজেই বিপুল পরিমাণ পছন্দের খাবারের জোগান এবং অনুকূল আবহাওয়ার কারণে খুব সহজেই এরা আমাদের দেশে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে। পাতার নিচের অংশ থেকে রস শুষে খেয়ে ফসলের প্রভূত ক্ষতিসাধন ছাড়াও এরা অনর্গল ‘হানি ডিউ’ অথবা আঠাল মধুর ন্যায় মিষ্ট তরল নিঃসরণ করতে থাকে। এই ‘হানি ডিউ’ আশেপাশের এবং নিচের পাতায় পড়ার পর তার উপর ‘ব্ল্যাক শুটি মোলড’ বা কালো রঙের ছোপ বিশিষ্ট ছত্রাক বাসা বাঁধে। এর ফলে গাছের পাতার উপরিভাগ সম্পূর্ণ কালো আস্তরণে ঢেকে যায় এবং তা গাছের সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় বাঁধা প্রদান করে।
নারকেলের সাদা মাছির পূর্ণাঙ্গ দশা সাধারণ সাদা মাছির তুলনায় ৩ গুণ (প্রায় ২.৫ মিলিমিটার) বড় হয় এবং এরা বেশ অলস প্রকৃতির। একটি পূর্ণাঙ্গ মাছির ডানার রঙ সাদা হয় এবং অগ্রভাগের ডানায় হালকা বাদামী রঙের ছোপ দেখতে পাওয়া যায়। পুরুষ মাছির দেহের নিম্নভাগে সাড়াশির ন্যায় গঠন দেখতে পাওয়া যায়।
স্ত্রী মাছি পাতার নিম্নভাগে বৃত্তাকার অথবা সর্পিলাকার নকশায় ডিম পাড়তে থাকে। এরপর নিজেদের ডিমগুলিকে সাদা রঙের মোম জাতীয় পদার্থ দিয়ে ঢেকে দেয়। ডিমগুলি দেখতে অনেকটা উপবৃত্তাকার এবং হালকা সাদা থেকে হালকা হলুদ বর্ণবিশিষ্ট হয়ে থাকে। দেখা গিয়েছে, একটি পূর্ণাঙ্গ স্ত্রী মাছি অনেকসময় অ-উদ্ভিদ উপরিভাগ যেমন, বাড়ির দেওয়াল, গাড়ির উপরিভাগ, জানলা এবং কাঁচের মতো মসৃণ সমতলেও নিজেদের ডিম পেড়ে থাকে।
এই সাদামাছির জীবনচক্রে মোট পাঁচটি দশা রয়েছে। ডিম ফুটে বেরোনোর পর প্রথম দশাটিকে প্রথম ইন্সটার দশা অথবা ক্রলার দশাও বলা হয়। এই দশাতে এরা এদের মুখের অগ্রভাগে সূচের ন্যায় অঙ্গ দিয়ে পাতার রস শুষে খায়। এর পরের অপরিণত দশাতে এরা চলাফেরা করা বন্ধ করে দেয়, এবং এদের গঠন পরিবর্তন হয়ে ধীরে ধীরে গোলাকার হতে থাকে। নিম্ফ দশায় এরা প্রায় ১-১.৫ মিলিমিটার দীর্ঘ এবং সোনালি বর্ণের হয়ে থাকে। এই দশায় এরা নিজেদের শরীরের চারিপাশে মোম জাতীয় পদার্থ দিয়ে সুতোর ন্যায় গঠন দিয়ে একপ্রকার জাল বুনতে থাকে এবং তা ধীরে ধীরে ঘন হতে থাকে। এর পর অর্থাৎ পিউপা দশায় এরা রূপান্তরিত হয়। সাধারণত এদের এই দশা দেখেই এদের সঠিক ভাবে সনাক্ত করা হয়ে থাকে।
নিয়ন্ত্রণ কৌশল:
১. যেসব পাতায় কালো ছোপ বা ‘Black Sooty Mould’ রয়েছে, সেখানে ১% স্টার্চের দ্রবণ স্প্রে করুন। স্টার্চ শুকিয়ে গেলে তা পাঁপড়ের মত কালো ছোপ গুলি সমেত উঠে আসবে।
২. বাগানে প্রতি নারিকেল গাছে হলুদ রঙের আঠালো ফাঁদ/Sticker ব্যবহার করুন। যেকোনো নিকটবর্তী সার-কীটনাশকের দোকানে এটি পাওয়া যায়।
৩. বাগানে বন্ধু পোকা/natural predator নিয়ে আসুন।
৪. অযাচিত ভাবে রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগ করুন। প্রকোপ খুব বেশি হলে পাতায় এবং গাছের কাণ্ডে ০.৫% নিম তেলের মিশ্রণ স্প্রে করতে পারেন।
৫. যেহেতু, এটি নতুন ধরনের একটি কীট, তাই কোনভাবেই একই কীটনাশক ব্যবহার করা যাবে না। একই রাসায়নিক বারংবার ব্যবহার করলে এরা সহজেই তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। তার ফলে পরবর্তীকালে তাদের নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়তে পারে। যদি, নিম তেল প্রয়োগে একান্তই সুফল না পাওয়া যায়, তবে এই নিম্নলিখিত, রাসায়নিকের মিশ্রণ যেমন, Acephate ৫০ + Imidacloprid ১.৮ SP (১ মিলিলিটার/লিটার জলে), Buprofezin ১৫ + Acephate ৩৫ WP (১ মিলিলিটার/ লিটার জলে) অথবা Thiamethoxam ১২.৬ + Lambda cyhalothrin ৯.৫ ZC (০.৫ মিলিলিটার/ লিটার জলে) আঠা সহযোগে ব্যবহার করতে পারেন।
তথ্যসূত্র - আরজু আলী খান
স্বপ্নম সেন(swapnam@krishijagran.com)
Share your comments