নারকেল, শুধুমাত্র ফল নয়, এই গাছটির সমস্ত অংশই, তা সে পাতাই হোক বা ফলের খোল, ছিবড়েই হোক বা মূল গাছ - সমস্তটাই ব্যবহার্য, যে কারণে এটিকে কল্পবৃক্ষ বা কল্পতরু হিসাবেও অভিহিত করা হয়। ভোজ্য তেল হিসাবেও আমাদের দেশের দক্ষিণের, বিশেষত সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকাগুলিতে এর ব্যবহার বহুল প্রচলিত। নারকেল গাছের আয়ুকাল ৫০-৬০ বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে, সে কারণে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এর চাষ করার ক্ষেত্রে স্থায়ী বাগান থাকাটা একান্ত আবশ্যিক, যা মূলত কেরল, তামিলনাড়ু রাজ্যেই হয়ে থাকে। আর যে সব রাজ্যে কম-বেশি নারকেল চাষ হয়ে থাকে তার মধ্যে রয়েছে আন্দামান, লাক্ষাদ্বীপ, অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ ইত্যাদি। গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল হওয়ার দরুণ আমাদের রাজ্যে বাণিজ্যিকভাবে নারকেল চাষ যথেষ্ট লাভজনক। আমাদের রাজ্যে যদিও অপরিপক্ক নারকেল অর্থাৎ ডাবের ব্যবহার সব থেকে বেশি। রোগীর পথ্য হিসাবে অন্যান্য পানীয়র পাশাপাশি ডাবের জলের ব্যবহার প্রচলিত, বিশেষত গ্রীষ্মের তপ্ত দিনগুলিতে। বাণিজ্যিকভাবে আমাদের দেশের যে কয়টি রাজ্যে নারকেলের ব্যাপক চাষ হয় সেখানে ভোজ্য তেল (৫০-৭০ শতাংশ) নিষ্কাশন ছাড়াও এর খোলা ও ছোবড়াটিকে দড়ি, ম্যাট্রেস, বিভিন্ন হস্তশিল্প ও অন্যান্য শিল্পে ব্যবহার করা হয়। নারকেলের তেল মার্জারিন, ঘি, সাবান উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়াও, নারিকেলের খইল গবাদি পশুর খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। নারকেল গাছের পাতা মাদুর, গৃহের আচ্ছাদন, ঝুড়ি, পর্দা ও ঝাঁটা তৈরিতে ব্যাপক ভাবে ব্যবহার করা হয়। মূল গাছটি কাঠ ও জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত হয়। সুতরাং নারকেলের জনপ্রিয়তা শুধু খাদ্য হিসাবেই নয় তন্তু এবং তৈলবীজ হিসাবেও, আর ঠিক সে কারণেই কল্পবৃক্ষ হিসাবে এর নামকরণও সার্থক।
আবহাওয়া (Climate) -
ক্রান্তীয় এলাকাভুক্ত অঞ্চলে যে ধরনের আবহাওয়া থাকে যেমন উজ্জ্বল সূর্যালোক, উচ্চ আর্দ্রতা এবং পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত, তা নারকেল চাষের জন্য আদর্শ। ঠান্ডা ও কুয়াশাযুক্ত আবহাওয়া নারকেলের জন্য ক্ষতিকর। খরা বা দীর্ঘ সময় জল জমে থাকা গাছ সহ্য করতে পারে না।
মাটি:-
মূলত বেলে, দোয়াঁশ বা উপকূলবর্তী বেলে মাটি বা নদীর সন্নিহিত এলাকার মাটি এই ফসল চাষের জন্য উপযুক্ত।
জাত:- গাছের উচ্চতার তারতম্যের উপর ভিত্তি করে নারকেলের জাতকে দুভাগে ভাগ করা হয়-
১) লম্বা জাত: কল্পমিত্র, কল্যাণী নারকেল,ইস্ট কোস্ট টল, দেশি লম্বা, হাজারি।
২) বেঁটে জাত: কেরালা বেঁটে, হলুদ বেঁটে, মালয়লাম হলুদ বেঁটে।
৩) সংকর জাত: চন্দ্রকল্প, কেরাচন্দ্র, কেরাশঙ্করা
বীজ সংগ্রহ ও বংশবিস্তার:-
নারকেলের বীজ থেকে চারা উৎপাদন করা হয়। ২৫-৩০ বছর বয়সি উচ্চফলনশীল গাছ বছরে ৮০টি ফল দেয়। সুস্থ, নীরোগ ও কমপক্ষে ৩৫টি সবুজ পাতাযুক্ত মা-গাছ থেকে বীজ নেওয়া হয়ে থাকে। ফেব্রুয়ারি-মে মাসে উৎপাদিত ১১-১২ মাস বয়সের ও ১২০০ গ্রাম ওজনের ফল বীজ হিসাবে আদর্শ। বর্ষার পরেই সারি থেকে সারি ১ ফুট দূরত্বে ও ১৫ ইঞ্চি দূরত্বে প্রতিটি বীজ লাগাতে হবে। বীজতলা সাধারণত লম্বায় ২৫ ফুট ও চওড়ায় ৫ ফুট হয়ে থাকে। বর্ষায় জল জমার সম্ভাবনা থাকলে বীজতলাগুলি ৬-১২ ইঞ্চি উঁচু করে দেওয়া যেতে পারে। বীজতলায় ২-৩ দিন অন্তর হালকা সেচ দিতে হবে এবং যতটা সম্ভব আগাছামুক্ত রাখতে হবে। ৯-১২ মাসের মধ্যে বীজ থেকে রোপণযোগ্য উপযুক্ত চারা তৈরি হয়ে যায়।
চারা নির্বাচন:-
মূলজমিতে রোপণের জন্য বাছাই করা চারা সতেজ, নীরোগ, লম্বা জাতের ক্ষেত্রে গোড়ার পরিধি ১০ সেমি ও বেঁটে জাতের ক্ষেত্রে ১২ সেমি হওয়া প্রয়োজন। চারাতে কম করে ৬-৮টি পাতা থাকা প্রয়োজন, যার ২-৩টি পাতা সম্পূর্ণ খুলে থাকা আবশ্যক।
মূল জমি:-
খোলামেলা সারাদিন রোদ থাকা ও জল নিকাশি ব্যবস্থাযুক্ত জমি চারা রোপণের জন্য বেছে নিতে হবে। রোপণের একমাস আগে বর্গাকার পদ্ধতিতে গর্ত খোঁড়া হয়। ১মি দৈর্ঘ্য × ১মি চওড়া × ১মি গভীর মাপের গর্ত করে দু-সপ্তাহ রোদ খাইয়ে গর্তের উপরের মাটির সঙ্গে ২০ কেজি গোবর সার, ৫০০ গ্রা নিমখোল, ২৫০ গ্রা হাড় গুঁড়ো ও ২৫ গ্রা সোহাগা মিশিয়ে তা গর্তের নীচের অংশ ভরাট করতে হবে এবং নীচের মাটি দিয়ে গর্তের উপরে অংশ ভরাট করতে হবে। একটি উদ্ভিদ থেকে অপর উদ্ভিদ ও এক সারি থেকে অপর সারিতে ৭.৫ সেমি দূরত্বে গাছ রোপন করা উচিত। কম দূরত্বে চারা রোপণ করলে গাছ বেঁকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
সার প্রয়োগ (Fertilizer application)-
সাধারণত বীজ লাগানোর ৬-৭ বছরের মধ্যে ফলন শুরু হয়। ভালো ফলন পেতে প্রতিটি ফলন্ত গাছে বছরে দু'বার বর্ষার আগে ও পরে প্রতি বারে ৪০ কেজি জৈব সার, ৫০০-৬০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৭০০-৮০০ গ্রাম সিঙ্গেল সুপার ফসফেট ও ৮০০-৯০০ গ্রাম মিউরিয়েট অফ পটাশ দিতে হবে। প্রতিটি ফলন্ত গাছে প্রথম বছরের দ্বিগুণ সার দ্বিতীয় বছরে ও তিনগুণ সার তৃতীয় বছরে দিতে হবে। এ ভাবে প্রথম ৫ বছরে সারের পরিমাণ বাড়িয়ে ৫ বছর পর আর সারের পরিমাণ না বাড়িয়ে ঐ মাত্রাতেই প্রতি বছর বর্ষার আগে ও পরে সার দিতে হবে। বয়স অনুযায়ী গাছের চারপাশে গোড়া থেকে ১-২ মি. দূরত্বে ৩০সেমি গভীর, ৪৫সেমি চওড়া নালা কেটে বয়স অনুযায়ী সার প্রয়োগ করা হয় ও প্রয়োজনে হালকা সেচ প্রয়োগ করা হয়।
(coconut cultivation) নারকেল চাষে রোগ ও কীট নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি
সাথী ফসলের চাষ:-
নারকেল বাগানের অন্তর্বর্তী জায়গায় সাথী ফসল হিসাবে আদা, হলুদ, গোলমরিচ, বিভিন্ন সবজি, স্বল্পমেয়াদী ফল, ওষধি ইত্যাদি ফসল চাষ করা যায়।
পরিচর্যা:-
অনুসেচ ব্যবস্থাপনায় বিন্দু সেচ পদ্ধতিতে সেচ প্রদান অধিক লাভজনক। আচ্ছাদন দিয়ে গাছের গোড়ার আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। গাছের কাঁচা পাতা অযথা কাটা চলবেনা, শুধুমাত্র শুকনো পাতা-কাঁদি কাটা যেতে পারে। রোপণের প্রথম দুবছর গাছে ছায়া প্রদান ও সুরক্ষিত রাখতে বেড়া দেওয়া আবশ্যক।
ফল কাটা ও উৎপাদন:-
নারকেলের ফলন শুরু হওয়ার পর থেকেই নিয়মিত ভাবে প্রতি পাতার মূল প্রান্ত থেকে নারকেলের মঞ্জরী বের হয় এবং প্রতি মঞ্জরীতে অসংখ্য ছোট ছোট নারকেল হতে শুরু করে। নারকেলের ফুল, মঞ্জরী আসার এক বছরের মধ্যে পূর্ণ বয়সের হয়ে যায় এবং ১২ বা তার বেশি ডাবের কাঁদি গাছ প্রতি উৎপাদিত হয়। ডাব হিসাবে ব্যবহারের জন্য ৫-৬ মাস বয়সের ফল তোলা হয়, অপরপক্ষে নারকেল হিসাবে ব্যবহারের জন্য ১১-১২ মাস বয়সের পরিণত হালকা সবুজ বাদামি রঙের ফল তোলা হয়। একটি উন্নত লম্বা জাতের গাছ থেকে গড়ে ৮০-১০০টি এবং একটি হাইব্রিড জাতের গাছ থেকে ১২০-১৪০টি ফল পাওয়া যায়।
তথ্যসূত্র - ড. শুভ্রমাল্য দত্ত (বরিষ্ঠ গবেষক, উদ্যানবিদ্যা অনুষদ, বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়)
Image source - Google
Related link - (Control Coconut whiteflies) নারকেল চাষিদের আতঙ্ক সাদা মাছি - নিয়ন্ত্রণ করুন এই পদ্ধতিতে
Share your comments