জামরুলের বৈজ্ঞানিক নাম 'Syzygium samarangense', ইংরেজি নাম: Champoo (থাই ভাষা) জামরুল হালকা মিষ্টি স্বাদযুক্ত একটি রসালো গ্রীষ্ম কালীন ফল। সারা দেশের বসত বাড়ির আশেপাশে বা পুকুরের ধারে বিক্ষিপ্তভাবে এ ফলের দু’ একটি গাছ দেখা যায়। জায়গার অভাব হলে বাড়ির ছাদে হাফ ড্রামেও জামরুল গাছ লাগানো যায়। এটি ভিটামিন বি-২ সমৃদ্ধ একটি ফল।এ ফলে প্রচুর পরিমাণে পানি থাকায় ডায়াবেটিস রোগীর তৃষ্ণা নিবারণে উপকারী। জামরুলে আমিষ, খনিজ লবণ, ভিটামিন সি, লৌহ ও ক্যারোটিন রয়েছে।
জামরুলের উপকারিতাঃ জামরুলে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন সি ছাড়াও আয়রন, ক্যালসিয়াম, সালফার,পটাশিয়াম ইত্যাদি উপাদান বিদ্যমান। ডায়াবেটিক রোগীর জন্য জামরুল খুবই উপকারী। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে এবং ত্বকের স্বাস্থ্য রক্ষায় জামরুল খুব ভালো কাজ করে থাকে। বাত নিরাময় এবং চোখের নিচের কালো দাগ দূর করতেও জামরুল গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে।
জলবায়ু (Climate) :
উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু জামরুল চাষের জন্য অধিক উপযোগী। অতি ঠান্ডা বা গরম উভয়ই জামরুল গাছের জন্য ক্ষতি কর।
জাত: প্রধানত তিন ধরনের জামরুল ফল দেখা যায়। ধবধবে সাদা, সবুজাভ সাদা ও গোলাপীলাল বা মেরুন বর্ণের।
বংশ বিস্তার:
গুটি কলম ও শাখা কলমের মাধ্যমে বংশ বিস্তার কারা যায়। সাধারণত ফল সংগ্রহের পর গাছে নতুন পাতা গজাতে শুরু করলে কলম করা উচিত। শাখা কলমের জন্য এক বছর বয়সী গাছ নির্বাচন করে মে-জুন মাসে কমল করতে হবে। শাখা কলমের জন্য বর্ষা মৌসুমে ৪ থেকে ৫টি পর্ব সহকারে ডাল কেটে বেডে বা পলিব্যাগে রাখাতে হবে। রোপণকৃত ডাল থেকে নতুন কুঁড়ি বের হলে তা পরবর্তী বছরে মূল জমিতে বা তৈরীকৃত মাদায় রোপণ করতে হবে।
জমি নির্বাচন ও তৈরী:
সুনিকাশিত দোঁ-আশ মাটি জামরুল চাষের জন্য বেশি উপযোগী। তবে সব ধরনের মাটিতেই জামরুল চাষ করা যায়। বৃষ্টি পানি জমে না এমন ধরনের উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি নির্বাচন করতে হবে। চাষ দিয়ে অথবা কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে সমতল ও আগাছামুক্ত করতে হবে।
রোপণ পদ্ধতি (Planting) :
সমতল ভূমিতে বর্গাকারে বা ষড়ভূজী এবং পাহাড়ী এলাকায় কণ্টুর পদ্ধতিতে চারা/ কমল রোপণ করা হয়। মধ্য জ্যৈষ্ঠ থেকে মধ্য শ্রাবণ মাস হলো জামরুলের চারা/ কলম রোপণের উপযুক্ত সময়। তবে পানি সেচের সুবিধা থাকলে বৈশাখ থেকে মধ্য কার্তিক মাস পর্যন্ত জামরুলের চারা রোপণ করা যায়।
গর্ত তৈরী:
কলম রোপণের ১৫ থেকে ২০ দিন পূর্বে ৬ মিটার দূরত্বে ১ মিটার গভীর গর্ত করতে হবে। গর্তের ওপরের মাটির সাথে ১৫ থেকে ২০ কেজি জৈব সার, ২৫০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম এমওপি ও ১০০ গ্রাম জিপসাম সার ভালভাবে মিশিয়ে গর্তটি ভরাট করে তাতে পানি দিতে হবে।
গর্তে চারা/ কলম রোপণ ও পরিচর্যা:
গর্তে সার প্রয়োগের ১০ থেকে ১৫ দিন পর নির্বাচিত কলমটি গর্তের মাঝখানে খাড়াভাবে রোপণ করে প্রয়োজন মতো পানি, খুঁটি ও বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
গাছে সার প্রয়োগ:
বৃদ্ধির সাথে সাথে গাছে প্রয়োজনীয় পরিমাণ সার প্রয়োগ করতে হবে। গোবর ইউরিয়া , টিএসপি ,এমওপি উপযুক্ত পপরিমাণে ব্যবহার করা হয়।
প্রতিবার সার দেয়ার পর প্রয়োজনে সেচ দিতে হবে।
আগাছা দমন:
গাছের গোড়া সব সময় আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। সাধারণত বর্ষার শুরুতে ও বর্ষার পর সম্পূর্ণ বাগানে হালকা চাষ দিয়ে আগাছা পরিস্কার করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন - বিজ্ঞান সম্মত ভাবে লাভজনক তামাক চাষ
পানি সেচ ও নিষ্কাশন:
জামরুলে পানির ভাগ বেশি থাকার কারণে খরা মৌসুমে অবশ্যই পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় পানির অভাবে ফলের আকার ছোট হবে এবং ফল ঝরে পড়তে পারে। সাধারণত খরা মৌসুমে গাছে প্রয়োজন মতো ২ থেকে ৩ বার সেচ দিলে গুণগত মান সম্পন্ন ফল পাওয়া যায়। বর্ষা মৌসুমে প্রয়োজনীয় নালা কেটে গাছের গোড়া থেকে অতিরিক্ত পানি নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
ডাল ছাঁটাইকরণ:
রোগও পোকা-মাকড় আক্রান্ত ডালপালা কেটে পরিস্কার করতে হবে। গাছ ছোট অবস্থা থেকেই প্রচুর ডালপালা বিস্তার করে বিধায় প্রথম থেকেই ফল দেওয়া কাংক্সিক্ষত ডালগুলো রেখে অন্যান্য ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে। সাধারণত ফল সংগ্রহ করার পর পর ভেঙ্গে যাওয়া ও মরা ডাল কেটে ফেলতে হবে।
ফল পাতলাকরণ ও ব্যাগিং:
জামরুল সাধারণত একই পুষ্পমঞ্জুরীতে অনেকগুলো ফল থাকে বিধায় অপরিপক্ক অবস্থাতেই কিছু ফল ছেঁটে দিতে হবে। প্রতি পুষ্পমঞ্জুরীতে ২ থেকে ৩ টি ফল রাখলে ফলের আকার বড় হয়। পরিপক্ক ফল বেশ আকর্ষণীয় রঙয়ের হওয়ায় ব্যাগিং করে পাখি ও পোকার আক্রমণ রোধ করা যায়।
রোগ বালাই ও পোকা দমন:
জামরুল গাছে পোকা-মাকড় ও রোগবালাইয়ের তেমন কোনে উপদ্রব দেখা যায় না। কচি পাতা খেকো পোকার আক্রমণ কদাচিৎ দেখা যায়। এদের দমনের জন্য প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি সুমিথিয়ন মিশিয়ে আক্রান্ত গাছে স্প্রে করতে হবে।
ফল সংগ্রহ:
ফল পূর্ণতা প্রাপ্তির পর সংগ্রহ করতে হবে। বারি জামরুল-১ এর ফল মধ্য বৈশাখ থেকে মধ্য জ্যৈষ্ঠ মাসে সংগ্রহ করা হয়। পরিপক্ক ফল গাঢ় তামাটে থেকে মেরুন বর্ণ ধারণ করে এবং পরিপুষ্ঠ ও টস টসে হয়। পরিপক্ক ফল হাত অথবা জালিযুক্ত বাঁশের কোটার সাহায্যে সংগ্রহ করা হয়।
সংরক্ষণ:
ফল সংগ্রহের পর আঘাত প্রাপ্ত ও নষ্ট হওয়া এবং পোকা-মাকড় আক্রান্ত ফলগুলো আলাদা করতে হবে। ভাল মানের ফলগুলো মুছে পরিস্কার করে ঠান্ডা জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে।
ফলন:
উপযুক্ত যত্ন নিলে জামরুল চাষে হেক্টর প্রতি ১৫-২০ মেট্রিক টন ফলন পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন - তামাক চাষে অন্তর্বর্তী পরিচর্যা এবং কীটদমন পদ্ধতি
Share your comments