তামাক সারা বিশ্বব্যাপী একটি বিতর্কিত ফসল। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দীর্ঘদিন তামাক সেবন করলে মানব দেহে ক্যানসার বা অনুরূপ দুরারোগ্য ব্যাধির সৃষ্টি হয়। তামাক সাধারণত ধূমপানের উদ্দেশ্যে সিগারেট, বিড়ি, পাইপ ও হুঁকা, চিবিয়ে খাওয়ার জন্য জর্দা, দোক্তা এবং নাকে নেওয়ার জন্য নস্যি,মুখে দাঁত মাজার জন্য গুল ইত্যাদি বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
তামাক পাতায় উপক্ষারীয় উপাদান হিসেবে নিকোটিন থাকে, তাই তামাক পাতা ভেজানো জল কীটপতঙ্গ দমন করতে বিশেষ সাহায্য করে। রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করার ফলে বিষাক্ত যৌগের অবশেষ থেকে যায় ফসলের মধ্যে, কিন্তু নিকোটিন সালফেট একটি উচ্চ মানের জৈব কীটনাশক যার কোনো ক্ষতিকারক অবশিষ্টাংশ ফসলের সাথে থাকে না এবং স্বাস্থ্যের কোনো রকম ক্ষতি করে না।
জলবায়ু (Climate) :
তামাক চাষের জন্য উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুর একান্ত প্রয়োজন। ২২—২৬℃ তাপমাত্রায় তামাক চাষ ভালো হয়। তামাক বীজের অঙ্কুরদগমের জন্য ৩০℃ তাপমাত্রা প্রয়জন। অতি বৃষ্টিপাত তামাক চাষের জন্য ক্ষতিকারক। ১৪০০-২১০০ মিঃ মিঃ বার্ষিক বৃষ্টিপাত তামাক চাষের জন্য আদর্শ। গাছের আঙ্গিক বৃদ্ধির সময় বাতাসে আর্দ্রতা ৫০ শতাংশের কম থাকা উচিত নয়। তামাক পাতা পরিপক্কতায় পৌঁছলে বায়ুর আর্দ্রতা কম হলে ভালো হয়। পাতা সংগ্রহ কালে বৃষ্টিপাত হলে পাতার গুণগত মান হ্রাস পায়।
মাটি (Soil) :
প্রায় সব রকমের মাটিতেই তামাক চাষ করা যায়। তবে হালকা দোআঁশ মাটিতে তামাক চাষ ভালো হয়। মাটিতে পটাশিয়ামের কোন ঘাটতি থাকলে পাতার স্বাদ, বর্ণ ও গন্ধ নিম্ন মানের হয়। চাষের জমিতে ২ বছর অন্তর অন্তর সবুজ সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন। সু-নিষ্কাশিত বেলে- দোআঁশ মাটি তামাক চাষের জন্য অতি উত্তম।
বীজ বাছাই :
বীজে ধুলো, বালি, অন্য জাতের বীজ ও অপুষ্ট বীজ না থাকা বাঞ্ছনীয়। ভেজাল বীজ থেকে নিকৃষ্ট মানের তামাক উৎপন্ন হয়। তাই কোনো নির্ভর যোগ্য প্রতিষ্ঠান বা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তা দের সাথে যোগাযোগ করে ভালো বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
বীজতলা তৈরী ও বীজ বপন (Seed sowing) :
বীজতলার জন্য উঁচু ছায়াহীন জমি বাছাই করা প্রয়োজন। শ্রাবন মাসের মাঝামাঝি মাটিতে ‘জো’ বুঝে ৬-৮ বার চাষ দিয়ে মই দিয়ে মাটি খুব ঝুরঝুরে করতে হবে এবং জমির চারিদিকে নালা কেটে ১০’ × ৪’ আকারের বীজতলা তৈরী করতে হবে। বীজতলা মাটি থেকে ৬’’ উঁচু করে বানাতে হবে। বীজতলা পিছু ৫-৬ কেজি গোবর সার জমিতে চাষ দেওয়ার সময় দিতে হবে। প্রতিটি বীজতলায় ২০-২৫ কেজি কম্পোষ্ট সার, ৪৫ গ্রাম ইউরিয়া, ৪৫ গ্রাম K2SO2 বা ১৮০ গ্রাম ছাই দিতে হবে। সব্জীর মতো বীজতলায় চারা তৈরী করে তামাক লাগান হয়। ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে তামাক বীজ বপন শুরু করতে হয়। প্রতিটি বীজতলার জন্য ১০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন। এক হেক্টর (৭.৫ বিঘা) জমির জন্য ৩ কেজি দেশী তামাক এবং ৫ কেজি বিলাতি তামাক বীজের প্রয়োজন।
জমি তৈরী:
পূর্ববর্তী ফসল কাটার পর পরই জমিতে চাষ দিয়ে আগাছা ও পূর্ববর্তী ফসলের গোড়া পরিষ্কার করতে হয়। প্রায় ১০-১২ বার চাষ দিয়ে ও মই দিয়ে মাটি উত্তম রূপে ঝুরঝুরে করা প্রয়োজন।
চারা তোলা ও রোপন:
চারাকে শক্ত ও কষ্ট সহিষ্ণু করার জন্য বীজতলা হতে চারা তোলার ৫-৭ দিন আগে থেকে বীজতলায় জল সেচ বন্ধ করতে হবে, যাতে চারা নতুন জমিতে লাগানোর পর আঘাত সহ্য করতে পারে। তবে চারা তোলার আগে জল দিয়ে মাটি ভিজিয়ে দিতে হবে যাতে সহজেই সব শেকড় সহ চারা তোলা যায়। কার্তিক মাসের শুরু থেকে অঘ্রায়ন মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে রোপন শেষ করতে হয়। সারি বদ্ধ ভাবে চারা রোপন করা হয়ে থাকে। সারি হতে সারির দূরত্ব ৩-৩.৫ ফুট ও চারা থেকে চারার দূরত্ব ২ ফুট হওয়া দরকার। চারা রোপনের প্রথম ৩-৪ দিন সকাল-বিকাল চারা গাছের গোড়ায় জল দেওয়া প্রয়োজন।
আরও পড়ুন - জানুন পটলের বিভিন্ন রোগ ও তার নিরাময়ের ব্যবস্থাপনা
উন্নত জাত:
সিগারেট তামাক: গৌতমি, জয়শ্রী, হেমা, গোদাবরী স্পেশাল, স্বর্ণ, ভার্জিনিয়া গোল্ড, হ্যারিসন স্পেশাল
বিড়ি তামাক: আনন্দ-১১৯, আনন্দ-২৭, সুরাতি-২০, আনন্দ-২৩, ভেদাগঙ্গা-১, GT-4, NPN-190, GTH-1, GT-9, NBD-43, MRGTH-1, ABT-10
সিগার ও চুরুট তামাক: ভবানী স্পেশাল, লঙ্কা স্পেশাল, S-5, DR-1, KV-1, VV-2
দোক্তা, নস্যি ও হুঁকা তামাক: বৈশালী স্পেশাল, মীনাক্ষী, GT-6, DD-437, NP-70
সার প্রয়োগ:
হেক্টর প্রতি সারের মাত্রা ইউরিয়া ৭৫-৮০ কেজি, ট্রিপল সুপার ফসফেট ৫০-৫৫ কেজি, পটাশিয়াম ৭৫-৮৫ কেজি, তবে পটাশ সারের পরিবর্তে ৪-৫ কুইন্টাল সাধারণ ছাই প্রয়োগ করা যেতে পারে। জমিতে অধিক নাইট্রোজেন সর্বরাহ করলে তামাক পাতার গুণগত মান কমে যায়। এছাড়াও অধিক পরিমাণে গোবর সার ব্যবহার করলে তামাক পাতা পুরু হয়ে পড়ে ও সুগন্ধ নষ্ট হয়। তাই জমির উর্বরতার উপর নির্ভর করে সারের পরিমাণ নির্ধারণ করা প্রয়োজন। পটাশ সার হিসাবে মিউরেট অফ পটাশ না দিয়ে সালফেট অফ পটাশ দিতে হয়।
অন্তর্বর্তী পরিচর্যা:
চারা রোপনের ৭-৮ দিনের মধ্যে নতুন শেকড় ছাড়ে, এ সময় কোদাল বা খুরপি দিয়ে মাটি আলগা করে দিতে হয়, ঢেলার সৃষ্টি হলে তা ভেঙে দিতে হয়। তামাক জমিতে কমপক্ষে প্রায় ৩ বার আগাছা নিড়ানো দরকার। শেষ নিড়ানোর সময় দুই সারি তামাক গাছের মাঝ-খানের মাটি তুলে গাছের গোড়ায় দিতে হবে। ফলে দুই সারির মাঝে জল নিষ্কাশনের জন্য ছোট নালা সৃষ্টি হয় এর ফলে গাছ ও বেশ শক্ত ও পুষ্ট হয়। জমিতে জলের পরিমাণ বুঝে ২-৩ বার সেচ দিতে হতে পারে। হঠাৎ বৃষ্টি হলে যেন জমিতে জল না জমে সেদিকে নজর রাখা প্রয়োজন।
আরও পড়ুন - জানুন উপযুক্ত পরিচর্যার মাধ্যমে দেশি কুমড়ো চাষের পদ্ধতি
Share your comments