পশ্চিমবঙ্গের সবজি সমূহের মধ্যে অন্যতম ফুলকপি। ফুলকপি এখন আর শুধু শীতের সব্জি নয়। সারা বছরই বাজারে মেলে সাদা ফুলেভরা কপির। দাম অবশ্য খানিক বেশিই। তা হোক তবু স্বাদে গন্ধে কোনও পার্থক্য নেই। তাই ক্রেতার ভিড়ও মন্দ নয়। সে কারণেই কৃষকরাও ঝুঁকছেন গ্রীষ্মকালীন ফুলকপি চাষে।
গত দু’বছরে গরমে ফুলকপির চাষ বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। কৃষকরা মনে করেন শীতকালীন ফুলকপি চাষের ক্ষেত্রে লাভ বা ক্ষতির একটা আশঙ্কা থেকে যায়। কিন্তু তাঁদের বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে গ্রীষ্মকালীন ফুলকপি চাষের ক্ষেত্রে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
মূলত জুলাই অগস্ট মাসে গ্রীষ্মকালীন ফুলকপি চাষ করা হয়। ফসল উঠতে উঠতে বাঙালির উৎসব মরশুম। দুর্গাপুজো, লক্ষ্মীপুজোয় ফুলকপির চাহিদা থাকে ব্যপক। ফলে দাম সামান্য বেশি হলেও ক্রেতারা বিমুখ হন না। আর সেখানেই লাভের পথ খুলে যায়। তাছাড়া গত কয়েক বছরে শীতকালে ভারী বৃষ্টির মুখোমুখি হয়েছে এ রাজ্যের কৃষকরা। শীলকালের ফুলকপি অসময়ের বৃষ্টি সহ্য করতে পারে না। তাতে ফসলের ব্যপক ক্ষতি হয়। কিন্তু গ্রীষ্মে ফুলকপি এমন নয়। সাধারণ একটি উঁচু জমিতেই ফুলকপির চাষ করা হয়। চারার গোড়ায় জল দাঁড়িয়ে না গেলে ফসলের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে না। সে কারণেই উন্নত নিকাশিযুক্ত জমিতে গ্রীষ্মের কপি চাষ করা হয়।
মুর্শিদাবাদ উদ্যান পালন দফতরের জেলা আধিকারিক গৌতম রায় বলেন, “জমি উঁচু ও নিকাশি ব্যবস্থা যুক্ত হলেই গ্রীষ্মকালীন কপি চাষ করা যায়। জেলার বহু চাষীই এই চাষে যুক্ত হচ্ছেন ইদানীং। তবে বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ-জিয়াগঞ্জ, বেলডাঙার দুই ব্লকে এই চাষ সব থেকে বেশি হচ্ছে।” বহরমপুরের কৃষক সুভাষ মণ্ডল বলেন, ‘‘গ্রীষ্মে পটল, ঢেঁড়শ খেতে খেতে মানুষ বিরক্ত হয়ে যায়। আশ্বিন কার্তিক মাসে কপির খুব থাকে। তাই নতুন সব্জির দাম পেতে সমস্যা হয় না। লাভও ভালোই হয়।” নওদার চাষি সুজয় মণ্ডল বলেন, ‘‘ফসল তুলতে দিন ৫৫ সময় লাগে। সেটা ভরা উৎসব মরশুম- দুর্গাপুজো থেকে লক্ষ্মীপুজো, কালিপুজো, ভাইফোঁটা। শীতের কপি নিয়ে মানুষ দাম দর করলেও অসময়ে পাওয়া কপি নিয়ে অত দরাদরি করেন না। এতে কৃষকরা উৎসাহ পায়, আবার পকেটও ভরে।” বেলডাঙার চাষি মহিত শেখ, নওসাদ শেখ ও মদন বিশ্বাস বলেন, ‘‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে কপি চাষ করি। গতানুগতিক ফুলকপি চাষে অনেক ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু গ্রীষ্মকালীন কপিচাষ করে ক্ষতি তেমন নেই। বরং লাভই হয়েছে।”
চাষের পদ্ধতি –
চারা তৈরি -
ফুলকপির চারা বীজতলায় উৎপাদন করে জমিতে লাগানো হয়। বীজতলার আকার এক মিটার পাশে ও লম্বায় তিন মিটার হওয়া উচিত। সমপরিমাণ বালু, মাটি ও জৈবসার মিশিয়ে ঝুরঝুরা করে বীজতলা তৈরি করতে হয়। দ্বিতীয় বীজতলায় চারা রোপণের আগে সাত থেকে আট দিন আগে প্রতি বীজতলায় ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১৫০ গ্রাম টিএসপি ও ১০০ গ্রাম এমওপি সার ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। পরে চারা ঠিকমতো না বাড়লে প্রতি বীজতলায় প্রায় ১০০ গ্রাম পরিমাণ ইউরিয়া সার ছিটিয়ে দেয়া ভালো। প্রতি শতক জমিতে ফুলকপি চাষের জন্য এ রকম একখ বীজতলায় ২ থেকে ২.৫ গ্রাম বীজ বুনলেই চলবে।
চারা রোপণ -
বীজ গজানোর ১০ থেকে ১২ দিন পর গজানো চারা দ্বিতীয় বীজতলায় স্থানান্তর করতে হয়। চারায় পাঁচ থেকে ছয়টি পাতা হলেই তা রোপণের উপযুক্ত হয়। সাধারণত ৩০ থেকে ৩৫ দিন বয়সের চারা রোপণ করা হয়। সারি থেকে সারির দূরত্ব দেয়া লাগে ৬০ সেন্টিমিটার বা দুই ফুট এবং প্রতি সারিতে চারা থেকে চারার দূরত্ব দিতে হবে ৪৫ সেন্টিমিটার বা দেড় ফুট। চারা রোপণের সময় সতর্ক থাকতে হবে যেন শিকড় মুচড়ে বা বেঁকে না যায়। এতে চারার মাটিতে লাগতে দেরি হয় ও বৃদ্ধি কমে যায়।
সার ব্যবহার:
পচা গোবর জমি তৈরির সময় ৫০ কেজি দিতে হবে। প্রতি শতকে ইউরিয়া শেষ চাষের সময় ২৫০ গ্রাম, তার ২০ দিন পর ৫০০ গ্রাম এবং ৩৫ দিন পর ২৫০ গ্রাম। টিএসপি শেষ চাষের সময় ৭০০ গ্রাম দিতে হবে। এমপি শেষ চাষের সময় ২০০ গ্রাম, ২০ দিনপর ৩০০ গ্রাম এবং ৩৫ দিন পর ২০০ গ্রাম। জিপসাম জমি তৈরির সময় ৪০০ গ্রাম দিতে হবে। জিংক সালফেট শেষ চাষের পর ৪০ গ্রাম এবং সোহাগা শেষ চাষের সময় ৪০ গ্রাম।
২৫ থেকে ৩০ দিন বয়সের চারা সারি থেকে সারি ৫০ সে.মি. (২০ ইঞ্চি) এবং চারা থেকে চারা ৪০ সে.মি. (১৬ ইঞ্চি) দূরত্ব বজায় রেখে রোপণ করতে হবে। প্রথম ও দ্বিতীয়বার সার উপরি প্রয়োগের পর পরই সারির দু’পাশের মাটি আলগা করে গাছের গোড়ায় তুলে দিতে হবে। এতে সেচ ও নিষ্কাশন উভয় কাজে সুবিধা হবে। চারা রোপণের ৪৫ দিন পর কপি সংগ্রহ করতে হয়। শতকে ৬০-৮০ কেজি আর একরে ৬ থেকে ৮ টন ফুলকপি জন্মে।
সেচ ও আগাছা ব্যবস্থাপনা (Irrigation & Weed Management) -
সার দেয়ার পরপরই সেচ দিতে হবে। এ ছাড়া জমি শুকিয়ে গেলে সেচ দিতে হবে। জমিতে জল বেশি সময় ধরে যেন জমে না থাকে সেটাও খেয়াল করতে হবে। সার দেয়ার আগে মাটির আস্তর ভেঙে দিয়ে নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে।
বিশেষ পরিচর্যা :
ফুলকপি গাছের সারি মাঝে সার দেয়ার পর সারির মাঝখানের মাটি তুলে দু’পাশ থেকে গাছের গোড়ায় টেনে দেয়া যায়। এতে সেচ ও নিকাশের সুবিধা হয়। তবে ফুলকপির ফুল সাদা রাখার জন্য কচি অবস্থায় চার দিক থেকে পাতা টেনে বেঁধে ফুল ঢেকে দিতে হবে। সূর্যের আলো সরাসরি ফুলে পড়লে ফুলের রঙ তথা ফুলকপির রঙ হলুদাভ হয়ে যাবে।
ফসল তোলা ও ফলন :
সাদা রঙ ও আঁটসাঁট থাকতে থাকতেই ফুলকপি তুলে ফেলা উচিত। মাথা ঢিলা ও রঙ হলদে ভাব ধরলে দাম কমে যায়। একরপ্রতি ফলন ১৫ থেকে ২৫ টন, হেক্টরে ৩৫ থেকে ৬০ টন।
কীট আক্রমণ (Pest management) –
ফুলকপির সবচেয়ে ক্ষতিকর পোকা হলো মাথাখেকো লেদা পোকা। নাবি করে লাগালে সরুই পোকা বা ডায়মন্ড ব্যাক মথ বেশি ক্ষতি করে। বীজ উৎপাদনের জন্য চাষ করলে পুষ্পমঞ্জরীকে জাব পোকার হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। অন্যান্য পোকার মধ্যে ক্রসোডলমিয়া লেদা পোকা, কালো ও হলুদ বিছা পোকা, ঘোড়া পোকা ইত্যাদি মাঝে মাঝে তি করে থাকে। ফুলকপির পাতায় দাগ ও কালো পচা রোগ প্রধান সমস্যা। এ ছাড়া চারা ধসা বা ড্যাম্পিং অফ, কাব রুট বা গদাই মূল, মোজেইক, পাতার আগা পোড়া ইত্যাদি রোগও হয়ে থাকে। বোরন সারের অভাবে ফুলে বাদামি দাগ পড়ে ও কা ফাঁপা হয়ে যায়।
আবশ্যকীয় কার্যাবলী:
১. জল নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত উঁচু জমিতে চাষ করতে হবে।
২. আগাছা দমন করতে হবে।
৩. সেচ ও নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
৪. রোগ-বালাই দমনে উপযুক্ত ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
৫. অবশ্যই সোহাগা ব্যবহার করতে হবে।
৬. সঠিক বয়সের সুস্থ ও সবল চারা স্থানান্তর, পরিমিত সার, সেচ ও অন্যান্য অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা সঠিক সময় ও নিয়ম অবশ্যই সম্পাদন করতে হবে।
Share your comments