বিগত ৮ই মার্চ, ২০১৯-এ আন্তর্জাতিক নারীদিবস উপলক্ষে দেশের ৪৪ জন কৃতি মহিলাকে ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রী রামনাথ কোবিন্দ কর্তৃক অত্যন্ত সম্মানিয় নারীশক্তি পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। এই পুরস্কার ভারতের সবচেয়ে সম্মানিত সভ্য নাগরিক পুরস্কার।
এই ৪৪ জন মহিলা যারা বিভিন্ন পটভূমি থেকে অবতীর্ণ হয়েছেন, তাঁরা বিভিন্ন কর্মক্ষেত্র থেকে নিরন্তর প্রচেষ্টার মাধ্যমে সাফল্য অর্জন করেছেন, এদের কেউ কেউ সামাজিক সংস্কার, কেউবা প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনী আবার কেউবা মেডিক্যাল উৎকর্ষতায় জড়িত রয়েছেন।
৩০ বৎসর বয়সি রুমা দেবী, যিনি রাজস্থানের বারমের থেকে এসেছিলেন, তিনি রাষ্ট্রপতির হাত থেকে নারীশক্তি পুরস্কার নিয়েছেন, তাঁর বক্তব্য যে তিনি কোনোদিন ভাবতেও পারেন নি যে তিনি এতবড় সম্মান প্রাপ্তির যোগ্য।
তাঁর কথামত এই পুরস্কার প্রাপ্তির পর তিনি অত্যন্ত আগ্রহের সাথে সামাজিক কাজ করবেন অর্থাৎ তিনি আরও উদ্যমের সাথে কাজ করতে পারবেন। রুমাদেবী খুব কম বয়সে বিবাহ করেন এবং এখন তিনি সেলাই ফোরাই এবং নকশীকাঁথার কাজে অত্যন্ত দক্ষ। তিনি তাঁর গ্রামের কিছু মহিলাকে নিয়ে একটি স্বনির্ভর সমিতি তৈরি করেছেন যারা কাপড়ের নকসা করা ব্যাগ এবং অন্যান্য হাতের কাজের বিষয় তৈরির কাজ করছেন।
তাঁর কাছে এই পুরস্কার অত্যন্ত সম্মানের কারণ তিনি কখনো ভাবতেই পারেন নি যে এই পুরস্কার তিনি পেতে পারেন। তাঁর কথায়,” শুরুর দিকে আমাদের অনেক প্রতিবন্ধকতার সাথে সংগ্রাম করতে হয়েছে, আমার স্বামী ও দেওরকে আমার পরিকল্পনা সম্পর্কে সবিস্তারে জানাতে হয়েছে এবং তাদের সম্মতি নিতে হয়েছে। কিন্তু কয়েক বছর ধরে আমি সাফল্যের সিঁড়িতে উত্তোরণ করেছি, এবং এখন তাঁরা আমাকে ভীষণভাবে সমর্থন করছে।
রুমার পর আরেকজন কৃতি প্রজ্ঞা প্রসূন যিনি অ্যাসিড আক্রান্ত হবার পরও নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সাহস দেখিয়েছেন। তিনি নিজেকে এমন ভাবে তৈরি করেছেন যা কিনা অন্যান্য অ্যাসিড আক্রান্তের কাছে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
একজন অ্যাসিড আক্রান্ত মানুষকে তাঁর নিজের সাথে ও সমাজের সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়, এবিষয়ে কথা বলতে গিয়ে প্রজ্ঞা বলেছেন “সমাজের কাছ থেকে প্রাপ্তি ও ভালোবাসা পেতে হলে অনেক লড়াই সহ্য করতে হয়। ২০০৬ সালে আমার বিয়ের মাত্র ১২ দিনের মাথায় আমি অ্যাসিড দ্বারা আক্রান্ত হই।“ প্রজ্ঞার কথার মত তাঁর জীবনের গণিত সম্পূর্ণটাই পরিবর্তন হয়ে যায়, আসলে প্রজ্ঞা নিজের জীবনের প্রতি খুব ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেছেন তাই অ্যাসিডের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে তাঁর রূপ যৌবন হারানোর ঘটনাটিও তাঁর সাফল্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি।
প্রজ্ঞা বর্তমানে একটি এন জি ও পরিচালিত করছে যেটির নাম অতিজীবন ফাউন্ডেশন, এই সংস্থায় বিভিন্ন অ্যাসিড আক্রান্ত মেয়েদের আশ্রয় দেওয়া হয় এবং এদেরকে অর্থনৈতিক ভাবে স্বনির্ভর করে তোলা হয়। এখনো পর্যন্ত প্রজ্ঞার সংস্থা ২০০ জন অ্যাসিড আক্রান্ত মহিলার সেবা, আশ্রয় ও স্বনির্ভরতার পথ সুনিশ্চিত করতে পেরেছে।
এই অ্যাসিড আক্রমণ আমাকে অনেকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, বিশেষ করে মানসিক দিক থেকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। কিন্তু আমি তখন থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমি কখোনই একজন আক্রান্ত মানুষের মত বাঁচবো না। আমি সংগ্রাম করেছি প্রতিকূলতার সাথে এবং এখন আমি যে সব অ্যাসিড আক্রান্তদের পাশে দাঁড়িয়েছি তাঁদের বিনামূল্যে প্লাস্টিক সার্জারি করার কথা চিন্তাভাবনা করছি”-প্রজ্ঞা জোর দিয়ে এই কথা বলেছেন।
বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও নীতি লখনৌ এর ওয়ান স্টপ সেন্টার দ্বারা পরিচালিত হয়, এই সেন্টার সম্পূর্ণ সেচ্ছাসেবকদের মতো কাজ করছে। লখনৌ এর এই সংস্থাকেও নারীশক্তি পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে।
ভারতীয় নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রক থেকে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। এই পুরস্কারের জন্য যে মনোনয়ন করা হয় তা অত্যন্ত সূক্ষাতিসূক্ষভাবে নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে করা হয়েছিলো, যে সমস্ত ব্যক্তি বা সংস্থাকে নির্বাচিত করা হয় তাঁদের কার্যকারীতা, নারী কল্যাণে তাঁদের অবদান, ও গুরুত্ব বিচার করে তারপর নির্বাচিত করা হয়েছিলো।
যে সমস্ত বিভাগে পুরস্কার দেওয়া হয়েছিলো সেগুলি হলো-বিজ্ঞানী, উদ্যোক্তা, আবহাওয়াবিদ্, সামাজিক কর্মী, কৃষক, শিল্পী, রাজমিস্ত্রি, নারী নাবিক, নারী কমান্ডো ট্রেইনার, সাংবাদিক, নারী চিত্র পরিচালক, এবং আরও অনেক বিভাগের কৃতি মহিলাদের যারা তাঁদের স্বপ্নকে সামনে রেখে তাঁদের লক্ষ্যকে স্থির করে এগিয়ে চলেছে, এবং যে সমস্ত মহিলাদের অনেক বেশী জয় করার ইচ্ছে রয়েছে, শুধু তাঁদের কাজের পথকে আরও বেশী সচ্ছল করবার জন্যই তাঁদের পুরস্কৃত করা হয়েছে।
- প্রদীপ পাল (pradip@krishijagran.com)
Share your comments