
এক সময় স্থানীয় গ্রামের বাজার হাটগুলি ছিল গ্রামীণ অর্থনীতির মূল প্রকোষ্ঠ । সেটি আজও তার কঙ্কালসার অস্তিত্ব বহন করে আধুনিক যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে । উন্নত পরিষেবার সাথে পেকেজিং যুক্ত হয়ে তারই অতি আধুনিক রুপ পেয়েছে বতমান শপিংমল গুলো । এর ঝাঁ চক চকে রূপ আর আকর্ষণীয় বাজার দখলের কৌশলের সঙ্গে সমান দক্ষতায় কতটা পুরাতন বাজার গুলো টিকে থাকবে সেটা হয়তো ভবিষৎই বলবে । এখানে আমি সামান্য কয়েকটি জেলার বাজার হাটের বিবরণ দিয়ে বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করছি ।
আমদের উত্তরবঙ্গে কম বেশী ৭ টি জেলাতে ১ হাজারের মত ছোট বড় বাজার হাট আছে । তার মধ্যে কোচবিহার জেলায়-৮৪ টি,জলপাই গুরিতে-১৩৩ টি,মালদায়-১৭২ টি, উত্তরদিনাজপুরে ২৪৪, দার্জিলিং এ ১৫৪ টি উল্লেখযোগ্য ।
কোচবিহার জেলার বড় ও পুরাতন হাট বাজার গুলির মধ্য হলদিবাড়ি হাট,ধাপড়া হাট,নিশিগঞ্জ হাট,জামালদা হাট,রানীর হাট,গোঁসাই হাট,ঘোষকাডাঙ্গা,টিয়াবাড়ি,বোলর হাট,নেতাজি বাজার,নয়ারহাট,ভেটাগুরি, গোসানীমারী প্রভৃতি উল্লেখ য্যোগ্য ।
কোচবিহার জেলায় সবচেয়ে প্রাচীন ও নামী হাটগুলির মধ্যে একটি হাট হোল নিশিগঞ্জ হাট । এই হাটটি মুলতঃ পাটের কেনা বেচার জন্য উত্তরবঙ্গে নামকরা । সুপ্রাচীন কালে এই হাটে “শ্রমিক”বিক্রি পযন্ত হত বলে জানা যায় । কৃষকের উৎপাদিত এমন কোন জিনিষ নেই যে এই হাটে পাওয়া যায় না । এই হাটে একসময় চাষিদের উৎপাদিত সু প্রাচীন কালের ধানের বীজ,মসলা প্রভৃতি পাওয়া যেত আজ সেটা বিরল। এই হাটের জল নিকাশি একটি সমস্যা চিরকালের, এছাড়া আবজনা গুলির সঠিক নিষ্কাসন ও পুনরায় ব্যাবহারের বেবস্থা অন্য হাটের মতো এটিরও নেই । সরকারের আর্থিক অনুদানে কিছু দোকান পাট পাকা হয়েছে কিন্তু সবই পরিকল্পনাবিহীন ও অসমাপ্ত ।
জলপাইগুড়ি জেলার সবচয়ে পুরনো হাটের মধ্যে একটি ছিল ‘শামুকতলা’ হাট । যেটি এখন আলিপুর জেলার মধ্যে সীমাবধ্য । জিনিস পত্র কেনা বেচার ক্ষেত্রে,এখানে বিভিন্ন ভাষাভাসি মানুষের সমাগম ছাড়াও মাহিলা দল দ্বারা পরিচালিত রাজ্য সরকারের রাজস্য আদায়ের নিরিখে এটি একসময় জেলার সেরা হাট গুলির অন্যতম ছিল।হাটের দিন প্রায় ২০-৩০ হাজার মানুসের সমাগম হতো । এখানে মুলতঃ চা বাগান থেকে আসা শ্রমিকের পরিবার গুলিই প্রধান ক্রেতা হিসেবে ভিড় করে । কিন্তু বর্তমানে চা শ্রমিকের সময়ের তুলনায় পারিশ্রমিক এতটাই কম যে এই বাজার গুলিতে আগের মতো তার জৌলুস হারিয়েছে । এছাড়া জলপাইগুড়ি জেলার বড় বাজার হাট গুলি কিছু হল যেমন-শোভাগঞ্জ,ওদলাবাড়ি হাট, রামসাই,চালসা,পানবারি, গজলডোবা,জল্পেস,বউবাজার,বোদা গঞ্জ, বেলাকবা,বেরুবাড়ি,রাজার হাট,বানার হাট,গয়ের কাঁটা,ধুপগুড়ি,কালির হাট প্রভৃতি।
আলিপুরদুয়ার জেলার অন্যতম হাট গুলি হল- মাদারি হাট, কুমারগ্রাম,বারবিশা,বীরপারা,ফালাকাটা,জয়গা,সাংকোশ,শামুকতলা,কালচিনি,সান্তাল বাড়ি প্রভৃতি । এগুলিরও ধরন জলপাইগুড়ি জেলার মতই শুধু উল্লেখযোগ্য দু একটি হাট যা এই অঞ্চলের গোটা অর্থনীতি কে নিয়ন্ত্রন করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট তা হল ফালাকাটা বাজার ও জয়গা ।
দাজিলিং জেলার অন্যতম একটি বড় হাট হল মাটিগাড়া হাট । এই হাটের বর্ণনা পাওয়া যায় ব্রিটিশ লেখক Douglas W. Freshfield এর কাছে । তিনি এই হাটটিতে আগে হাতি, ঘোড়া, মহিষ পযন্ত বিক্রি হতো বলে বিবরণ দিয়েছেন । সমস্ত দাজিলিং এবং সিকিম এর পাহাড়ি মানুষের দৈনন্দিন প্রধান প্রয়োজনীয় জিনিষ গুলিই এখানে পাওয়া যায় । তবে বিশেষ আকর্ষণ ছিল পাহাড়ি পোশাক ও মাটির তৈয়ারি বিভিন্ন সামগ্রী ।কাছাকাছি শিলিগুড়ি শহর কেন্দ্রিক হওয়ায় এই হাটটি বর্তমানে আধুনিকতার সাথে মিলে মিশে গেছে এখানকার ক্রেতা বিক্রেতার ও পরিবর্তন হয়েছে অনেক তবে মুল সমস্যা থেকেই গেছে ।
দারজিলিং জেলার অন্যান্য হাট বাজার গুলি হল- কারসিয়াং বাজার,কালিম্পং বাজার,মিরিক,লাভা, প্রভৃতি । তবে উল্লেখযোগ্য হল এই যে, সমতল ও পাহাড়ের হাট বাজার গুলির মধ্যে চরিত্র গত কিছু পাথক্য আছে কারন সেখান কার মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে সমতলের মানুষের জীবনযাত্রার পাথক্য অনেকটাই ।
উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজ পুর জেলার বড় ও পুরাতন হাট বাজার গুলির মধ্যে পতিরাজপুর, চোপড়া,কালিয়াগঞ্জ,পাঞ্জিপাড়া,কানকি,ইসলামপুর,বিলাস পুর,পউটি,ফতেপুর,মোহনবাটি,হিলি,সরাই উল্লেখযোগ্য । এই দুটি জেলার হাট গুলির বিশেষত্ব হল এইসব হাটে নানা ধরণের সারা বছর ধরে প্রচুর শাক – সব্জি পাওয়া যায় । গরু এবং ছাগলের আমদানি ও রফতানির জন্য ভালো জাতের পশু মেলে ।
সুপ্রাচীন এই হাট বাজারের ইতিহাসে ক্রেতা ও বিক্রেতার এই আদিম সম্পর্কটি আজ কালের স্রোতে অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে,আধুনিকতা সেখানে প্রাচীনত্যকে ধীরে ধীরে তার আপন মোড়কে বড্ড ঊলঙ্গ করে দিয়েছে। তাই অন্যান্য হাট গুলির মতই সব হাট বাজারের বড় ও চিরকালের জলন্ত সমস্যা হল চাষিদের আনা দ্রব্য সামগ্রী ফরেরা দখল করে তার দাম নির্ধারণ করে। এতে চাষি অনেক সময়ই তার সামগ্রির সঠিক দাম পায় না। এছাড়া এখন পূরাতন হাট বাজার গুলির প্রতিদন্দি হয়ে পড়েছে পাড়ায় পাড়ায় মোড়ে মোড়ে নতুন করে গড়ে ওঠা দোকান বা ছোট ছোট বাজার গুলি। অনেকটা আধুনিক অনলাইন পরিষেবার মত বাড়িতে বাড়িতে ঘরে ঘরে সামগ্রী পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা। এটাতে ক্রেতা হিসেবে লাভ রয়েছে কেননা ক্রেতার সময় ও অর্থ দুটোই বাঁচে কিন্তু পণ্যের গুনমান ও চাষিদের কাছ থেকে সরাসরি কেনার সুযোগটাও এখানে কমে । এর ফলে চাষিরা তার উৎপাদিত পণ্য ধীরে ধীরে মধ্যস্বত্ব বা ফরেদের হাতে বিক্রি করে দিতে বাধ্য। কিন্তু আমি মনে করি আমদের রাজ্যে এই মুহুতে তাদের হাতে বিকল্প কোন ব্যবস্থা তৈয়ারি হয় নি । যতটুকুই বা হয়ছে তা এখনো মধ্যস্বত্ব ভোগীদের দখলে । আমাদের দেশের সরকারগুলি ও তাদের আমলারা চাষিদের “মধ্যস্বত্ব” ভোগীদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য এখনো সেভাবে আন্তরিক হতে দেখা যায় নি। না হলে আজ রাজ্যর প্রতিটি গুরুত্বপুণ ফসলের দাম নির্ধারিত হত (এলাকা ভেদে) এবং কৃষি জাগরণকে দেওয়া একটি সাক্ষাতকারে সন্মানীয় উত্তরবঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালযের বর্তমান উপাচার্য ডক্টর চিরন্তন চট্টোপাধ্যায় বলেন যে “আমাদের দেশ স্বাধীনতার ৭০ বছর পেরিয়ে গেলেও একটা বাজেট( রাজ্য কিম্বা কেন্দ্রের) এমন হয়নি যেটাকে “সম্পুণ রূপে” কৃষি বাজেট বলা যায় ! অথচ সেই ছোট বেলা থেকে শুনে আসছি এমনকি পাঠ্য পুস্তকে পরে এসেছি যে আমদের দেশ নাকি কৃষি প্রধান দেশ!” উপাচাযের সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকারটি পড়তে নজর রাখুন আমাদের পরবতী “কৃষি জাগরন” মাসিক পত্রিকায়।
- অমরজ্যোতি রায়
Share your comments