বেশ ধুমাধাম করেই শুরু হয়েছিল ময়না অ্যাকোয়াকালচার মডেল। লাভের আশায় সহযোগিতার হাতও বাড়িয়েছিল স্থানীয় মানুষ। শুধু তাই নয়, মৎস্য চাষের এইরকম মডেলকে অন্য ক্ষেত্রেও প্রয়োগের কথা ভেবেছিল সরকার। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে ব্যর্থতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে ময়না অ্যাকোয়াকালচার মডেলকে।
ময়না গ্রামেরই বাসিন্দা প্রদীপ দাস। সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসনের আশ্বাসে উৎসাহিত হয়ে নিজের ১৫০ একর ধান জমিকে ব্যবহার করেছিলেন মাছচাষ করার জন্য। তিনি ভেবেছিলেন ধানচাষের থেকে বেশি লাভ এনে দেবে মাছচাষ। কিন্তু ছ’বছর হয়ে গিয়েছে লাভ হওয়া তো দূরস্থান, ক্রমশ ক্ষতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাঁকে। কিন্তু হঠাৎ ধানচাষেই বা ক্ষতি হচ্ছিল কেন ? প্রদীপবাবু জানান, ময়নাতে ধানচাষের পাশে ছোট জলাশয়গুলি মাছচাষ করা হত। কিন্তু বন্যায় এই জলাশয়ের জল উপচে পড়ে ধানজমির ক্ষতি করছিল। সেইজন্যই চাষীরা আরও বেশি করে ধানচাষ ছেড়ে জমিকে জলাশয়ে পরিণত করেন।
ময়না মডেল কী (Moyna model) ?
ময়নার চাষীরা দীর্ঘদিন ধরেই ধানচাষের পাশাপাশি লাগোয়া জলাশয়গুলিকে ফেলে না রেখে মাছচাষ করেন। রুই, কাতলা, ট্যাংরা, চিতল বা তেলাপিয়া মাছ চাষে ভালোই লাভের মুখ দেখতে থাকেন সেখানকার মানুষ। এছাড়াও বন্যা হলেই ধানচাষের বিপুল ক্ষতিও তাঁদের বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল। মাছচাষের লাভ বেশি দেখে সেখানকার মানুষ পুরো চাষের জমিটিকেই জলাশয়ে রূপান্তরিত করেন। ৯০ দশকের শেষে দেখা যায়, ধানচাষের থেকে মাছচাষে তাঁরা লাভ করছেন বেশি। শীঘ্রই ময়না কমিউনিটি ব্লকের আরও ১১টি জেলায় এই ব্যবস্থা ছড়িয়ে পড়ে। এইভাবে দেখা যায়, ২০০টি ফার্মের অধীনে প্রায় ৭৫০০ হেক্টর জমি মাছচাষের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। এগুলিকে ‘খোপ’ বলা হয়। এক একটি ‘খোপ’ ২৫ একর থেকে শুরু করে ৪০০ একর পর্যন্ত হয়। নদী থেকে সরাসরি লাইন করা থাকে এই জলাশয়গুলিতে জল আনার জন্য।
এই খোপগুলির মালিক পাঁচ থেকে ছয় বছর অন্তর জলাশয়গুলির ইজারা নেয়। তাঁরাই ক্যানালগুলি থেকে জলাশয়গুলিতে ফ্রেশ জল ভরা, মাছের চারা ছাড়া বা মাছের খাবারের বন্দোবস্ত করেন। ক্রেতারা সরাসরি গ্রামেই আসেন মাছ কেনার জন্য।
অন্যান্য জেলাতেও এই নীতি প্রবর্তনের লক্ষ্য ছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের -
ময়নাতে মাছচাষের এই পরিমাণ লাভ দেখে ২০১৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার রাজ্যের বৃহত্তম ফিশারিজ হাব হিসেবে ময়না অ্যাকোয়াকালচার মডেলকেই বেছে নেয়। এই মডেল ব্যবহার করে সরকার চেয়েছিল রাজ্যের মৎস্য চাষকে উন্নত করতে। সেই সঙ্গে অন্য রাজ্য থেকে মাছ আমদানির পরিমাণকেও কমাতে। সরকার চেয়েছিল এই মডেল ব্যবহার করে রূপনারায়ণ থেকে জল নিয়ে এসে জলাশয়গুলিতে ব্যবহার করতে। ময়না থেকে রূপনারায়ণের দূরত্ব মাত্র ১০ কিমি। সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়, বছরে ৭০০০ হেক্টরে ৬০০০০ থেকে ৭০০০০ টন মাছ চাষ করতে সক্ষম।
প্রশাসনের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ চাষীদের -
এত আশা জাগিয়ে ক্রমশই লোকসানের মুখ দেখতে শুরু করল ময়না। স্থানীয়রা কাঠগড়ায় দাঁড় করাল প্রশাসনকে। সাহায্যের আশা দেখিয়েও হাত গুটিয়ে নিয়েছে প্রশাসন। অনেক প্রতিশ্রুতিও পূরণ হয়নি। যার ফলে বর্তমানে ক্ষতিগ্রস্ত ময়নার ১৫০০০০ চাষী। প্রদীপ জানিয়েছেন, সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সারা বছর রূপনারায়ণের জলের সরবরাহ দেওয়ার। কিন্তু সেই কাজ এখনও পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি, যার ফলে নদীর কাছের জমিগুলো জল পেলেও, দূরের জমিগুলোতে জলের অভাবে মাছ চাষের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। শুধু তাই নয়, সরকারের তরফে যে রাসায়নিক জলে প্রয়োগ করা হচ্ছে, তার ফলে বহু মাছ মারা যাচ্ছে। সরকারের কাছে বারবার জানানো সত্ত্বেও এ ব্যাপারে কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি।
বর্তমানে মাছদের মুরগিদের শরীরের অব্যবহৃত অংশ খাওয়ার জন্য দেওয়া হয়। কিন্তু এতে মাছের স্বাদ পরিবর্তন হয়েছে। মাছেদের অর্গানিক ফুড সাপ্লিমেন্ট খাওয়ানোর প্রস্তাব করেছিলেন অর্গানিক ফুড সাপ্লিমেন্ট কোম্পানির এক কর্ণধার শেখ নাজিমুদ্দিন। কিন্তু চাষীরা নাকি তা মেনে নিতে রাজি হয়নি। এছাড়াও চাষীরা দাবি জানিয়েছিলেন, একটি ল্যাবরেটরি এবং ট্রেনিং সেন্টারের, যেখানে এই মাছ চাষ নিয়ে তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে এবং ল্যাবরেটরিতে চাষের উন্নতির জন্য নিত্যনতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন করা হবে। শুধু তাই নয়, স্টোরেজের ব্যবস্থার কথাও জানানো হয়েছিল, যেখানে পরিবহনের জন্য যথেষ্ট বরফ রাখা থাকবে। ব্যাঙ্কের তরফ থেক লোণ গ্রহণেও সৃষ্টি হয় বেশ কিছু সমস্যার।
তাদের অভিযোগের প্রত্যুত্তরে সরকারের তরফে জানানো হয়েছে, রূপনারায়ণ থেকে জলের লাইন আনানোর কাজ লকডাউনের জন্য বর্তমানে বন্ধ রাখা হয়েছে। তাছাড়া চাষীরা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন বর্জ্যপদার্থ মাছেদের খাইয়ে আসছেন, যার ফলে মাছের স্বাদ এবং জলের গুণমান নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এদিকে জলস্তর নেমে যাওয়ায় মাটির তলার জলও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে এখন ক্রমশ ব্যার্থতার দিকে এই ‘ময়না মডেল’।
ত্রয়ী মুখার্জী
Image Source - দ্য ফিশ সাইট
Related link - (Fish farming in the Sundarban) আমফান ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত সুন্দরবনে মাছ চাষের পুনুরুজ্জীবনের একটি রূপরেখা
(Turkey rearing) টার্কি পালন আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যম
স্বল্প ব্যয়ে প্রচুর মুনাফা, কৃষক ঘরে বসেই শুরু করুন (Pearl Cultivation) মুক্তোর চাষ
Share your comments