রসুন- মিশর দেশে পূজিত হয় এর মহৌষধি গুণের জন্যে, আদৃত হয় ভারতে, ইটালিয় ও এশীয় খানাতে, এবং যাকে প্রাচীন ব্রিটেনে বলা হোতো “দুর্গন্ধ গোলাপ” বা Stinking Rose.
এটি আসলে একটি তীব্র অসহনীয় ঝাঁঝালো গন্ধযুক্ত মৃদ্গত কন্দমূল। প্রায় ৫০০০ বৎসরের ইতিহাস ঘাটলে জানা যায় প্রাচীন সভ্যতাগুলির প্রায় সবজায়গাতেই রসুনের খ্যাতি ছিলো খুবই ইর্ষনীয়।
বর্তমানে চীন, সাউথ কোরিয়া, ভারত, এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এই রসুন উৎপাদনে সমগ্র পৃথিবীতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। এই বস্তুটি যে শুধুমাত্র রান্নায় স্বাদ বাড়ায় তাই নয়, এটি আমাদের স্বাস্থ্যের ১২-১৩ রকমের উপকারও সাধন করে। তবে এই উপকার শুধুমাত্র তাজা রসুন থেকেই আশা করা যায়, কোনো রকম প্রসেসড্ রসুন থেকে কোনো উপকার পাওয়া সম্ভব নয়। রসুনকে যদি সঠিকভাবে মুক্ত পাত্রে, সূর্যালোকের থেকে বাঁচিয়ে রাখা যায় তবে তা প্রায় একমাস পর্যন্ত তাজা অবস্থায় থাকতে পারে।
বর্তমানে রসুন পৃথিবীর বহু স্থানে উৎপাদিত হয়। সাধারণত ঠাণ্ডা ও অন্ধকার আবহাওয়ায় রসুন উৎপাদন খুব ভালো হয়। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ জড়িবুটি হিসেবে বিভিন্ন প্রকার খাদ্যে ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং যে কোনো অবস্থাতে এটি অ্যান্টিসেপ্টিক হার্ব হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
রসুনের পুষ্টিগুণাবলী
মোট প্রাপ্ত শক্তি-১৪৯ ক্যালরি শর্করা – ৩৩ গ্রাম উদ্ভিজ্জ তন্তু – ২ গ্রাম ফ্যাট – ০.৫ গ্রাম প্রোটিন – ৬.৫ গ্রাম ভিটামিন C – ৩১ মিলিগ্রাম থায়ামিন – ০.২ মিলিগ্রাম রাইবোফ্ল্যাভিন – ০.১ মিলিগ্রাম নিয়াসিন – ০.৭ মিলিগ্রাম ভিটামিন B6 – ১.২ মিলিগ্রাম |
প্যান্টোথ্যানিক অ্যাসিড – ০.৬ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম – ১৮০ মিলিগ্রাম লোহা – ১.৭ মিলিগ্রাম ম্যাগনেসিয়াম – ২৫ মিলিগ্রাম ফসফরাস – ১৫৫ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম – ৪০০ মিলিগ্রাম জিঙ্ক – ১.২ মিলিগ্রাম তাম্র – ০.৩ মিলিগ্রাম ম্যাঙ্গানিজ – ১.৭ মিলিগ্রাম সেলেনিয়াম – ১৪.২ মিলিগ্রাম |
এখন দেখে নেওয়া যাক রসুন থেকে আমরা কি কি স্বাস্থ্যসম্মত উপকার পেতে পারিঃ
১। দেহের অতিভারী ধাতু অপসারণ
আমাদের দেহের মধ্যে অবস্থিত অতিভারী ধাতু যেগুলি আমদের শরীরের পক্ষে অত্যন্ত বিষাক্ত সেই সব ধাতু আমাদের পেশীকোষের চর্বিতে অন্তর্নিহিত থাকে। পরবর্তীকালে এগুলি আমাদের ক্যান্সার বা অংগনিষ্ক্রিয়তার মত রোগের সূচনা করতে পারে। রসুন আমাদের দেহ থেকে এই সমস্ত অপ্রয়োজনীয় অতিভারি পদার্থ গুলিকে অপসারিত করতে সক্ষম। যদি আপনি অত্যাধিক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেন বা খুব বেশী পরিমাণে মাছ বা সামুদ্রিক খাদ্য গ্রহণ করেন সেক্ষেত্রে আপনার রোজকার খাদ্য তালিকায় রসুনের উপস্থিতি একান্ত কাম্য।
২। অস্থিকলার পক্ষে উপকারি প্রভাব
রসুনের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে খনিজের উপস্থিতি লক্ষ্যনীয়, তাই রসুনের দ্বারা আমাদের অস্থিমজ্জার স্বাস্থ্য ঠিক রাখা সম্ভব, আসলে এই অস্থিমজ্জার স্বাস্থ্য বিষয়ে আমাদের কোনো যান্ত্রিক সহায়িকা নেই। তাছাড়া রসুন স্ত্রীদেহে ছদ্ম – ইস্ট্রোজেনের মতো কাজ করে ফলে একে গ্রহণ করলে স্ত্রীদেহের অস্থিমজ্জা ঠিক থাকে ও তাদের মেনোপোজের সময়কালও মন্দ্রীভূত হয়।
৩। শোণিত শোধক
রসুন এমন একটি উপকরণ যা আমাদের শরীরের অভ্যন্তরে রক্তকে ও শরীরের বহির্ভাগে চর্মকে পরিশোধিত করে। যদি প্রতিদিন এক কোয়া রসুন উষ্ণ জলের সাথে খাওয়া যায় এবং সারাদিন যদি প্রচুর জল খাওয়া যায় তবে এই রসুনের সামান্য কোয়াগুলি মানবশরীরের শোণিত শোধনে এক উপকারি সেবক হিসেবে কাজ করে যাবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এক্ষেত্রে রসুন কে ঈষদ-উষ্ণ জলে লেবু মিশিয়ে খেলে ভালো উপকার পাওয়া সম্ভব এবং সেটি খুব সকালে খালি পেটে গ্রহণ করতে হবে।
৪। সর্দি-গর্মিতে মোক্ষম দাওয়াই
রসুনের কোয়া বেটে মধু ও আদা মেশানো চায়ের সাথে খেলে তা সর্দি-গর্মি রোগের একটি মোক্ষম দাওয়াই। কোনো কারণে যদি নাক বন্ধ হয়ে যায় বা হালকা জ্বর থাকে তবে এই মিশ্রিত চায়েতেই কাজ হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে যদি শুধু গরম রসুনের স্যুপ খাওয়া সম্ভব হয় তাহলে সেটি যেমন উপকারী তেমনি সুস্বাদু ও দৈহিক আরামদায়কও বটে।
৫। হৃদয়ের স্বাস্থ্যরক্ষক
হৃদ্-স্বাস্থ্য সুরক্ষায় রসুন একটি কার্যকরি মহৌষধ। বহু গবেষণায় দেখা গেছে রসুন রক্তের কোলেস্টেরল ও ফ্যাটকে প্রশমিত করে, ফলে হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকে। এছাড়াও রসুন ব্যবহারের ফলে আরও কিছু রোগ প্রতিহত হয় যেমন-অ্যাথেরোক্লেরোসিস, হাইপারলিপিডিমিয়া, হাইপারটেনসন এবং থ্রম্বোসিস ইত্যাদি। এছাড়াও শিরা বা ধমনিতে রক্ত জমাট বাধার থেকেও রক্ষা করে এই সামান্য রসুন।
৬। উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ
গবেষণার থেকে জানা গেছে রসুন, মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রে উচ্চরক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। অবাক করার মতো ব্যাপার হলো এক ফোঁটা রসুনের নির্যাস দিয়ে খুব সহজেই রক্তচাপ কমানো যায়। রসুনের মধ্যে থাকে অ্যালিসিন যৌগ যা পাল্মোনারি আর্টারির পেশিকে স্থিতিস্থাপক রাখতে সাহায্য করে এবং আর্টারির মুখকে প্রশস্ত করে ফলে রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে।
৭। ক্যান্সার প্রতিরোধক
রসুনের মধ্যে যে সমস্ত পুষ্টি উপাদান গুলি নিহিত থাকে সেগুলি ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকটাই কমতে সক্ষম। রসুনের প্রাত্যহিক ব্যবহারে পাকস্থলী, বৃহদন্ত্র, এসোফেগাস, অগ্ন্যাশয়, প্রোস্টেট ও ব্রেস্ট ক্যান্সারের মতো ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকটা কমে যায়। আমেরিকার ন্যাশনাল ক্যান্সার ইন্সটিটিউট এর মতে রসুনের মধ্যে সবথেকে বেশী ক্যান্সার প্রতিরোধি ক্ষমতা রয়েছে।
৮। মধুমেহ ও রসুন
মধুমেহ রোগাক্রান্ত মানুষরাও রসুনের থেকে বিশেষ সুবিধা পেতে পারেন। পরীক্ষামূলক গবেষণা থেকে জানা গেছে এই রসুন রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিক রাখে ও মধুমেহ রোগীদের ক্ষেত্রে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে।
রসুন খাওয়ার নিয়ম
রসুন এর বিভিন্ন রোগহরণকারী গুরুত্বের জন্য একে “সর্বরোগহর” বলা হয়। তাই একে বিশেষ নিয়মানুসারে গ্রহণ করলে তা যথেষ্ট উপকারি। তেল ঝাল মশলার সাথে কষিয়ে রান্না করা রসুনের কোনো গুণবত্তা থাকে না, তাই কাঁচা রসুনের গন্ধ অসহ্য হলেও এই অবস্থায় রসুন খাওয়াই উচিত, কারণ কাঁচা অবস্থায় এর মধ্যেকার ভিটামিন ও খনিজগুলির কাজ অনেক বেশী হয়।
- প্রদীপ পাল
Share your comments