প্রকৃতিতে আমাদের অগোচরে কত গাছ গাছড়াই তো ছড়িয়ে আছে, এর কটাকেই বা আমরা চিনি। থানকুনি গাছ (বৈজ্ঞানিক নাম – সেন্টেলা এশিয়াটিকা) বা থানকুনি পাতা ভেষজগুণে সমৃদ্ধ যার মধ্যে রয়েছে শরীরের জন্য প্রচুর উপকারী খনিজ ও ভিটামিন জাতীয় পদার্থ। গ্রামাঞ্চলে বাড়ির আশেপাশে, রাস্তার পাশে কিংবা ক্ষেতের আলে ছোট ছোট তারার মত খাঁজকাটা এই পাতাগুলো দেখতে পাওয়া যায়। অনেক অভাবি মানুষ ভাতের সাথে এই পাতাটিকে বেটে খায়। আবার স্বাদের কারণে অনেক ধনীরাও এই পাতাটিকে ভর্তা করে খায়। তবে সব অঞ্চলের মানুষ থানকুনি পাতা নামে এই পাতাটিকে নাও চিনতে পারে। অঞ্চলভেদে এই পাতাটিকে টেয়া, মানকি, তিতুরা, থানকুনি, আদামনি, ঢোলামানি, থুলকুড়ি, মানামানি , ধূলাবেগুন, আদাগুনগুনি নামে ডাকা হয়।
ছোট্ট এই গাছটির মূল, কান্ড ও পাতার উপকারিতা:
১. পেটের রোগ নির্মূল করতে থানকুনির বিকল্প নেই। নিয়মিত খেলে যে কোনও পেটের রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। একই সঙ্গে পেট নিয়ে কোনও দিনও সমস্যায় ভুগতে হয় না।
২. শুধু পেটই নয়, আলসার, এগজিমা, হাঁপানি-সহ নানা চর্মরোগ সেরে যায় থানকুনি পাতা খেলে। ত্বকেও জেল্লা বাড়ে।
৩. থানকুনি পাতায় থাকে Bacoside A ও B। Bacoside B মস্তিষ্কের কোষ গঠনে সাহায্য করে ও রক্ত চলাচল বাড়ায়। থানকুনি পাতা নিয়মিত খেলে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায়।
৪. থানকুনি স্নায়ুতন্ত্রকে সক্রিয় রাখতে সাহায্য করে।
৫. মৃতকোষের ফলে চামড়ায় অনেক সময়ই শুষ্ক ছাল ওঠে। রুক্ষ হয়ে যায়। থানকুনি পাতার রস মৃতকোষগুলিকে পুনর্গঠন করে ত্বক মসৃণ করে দেয়।
৬. পুরনো ক্ষত কোনও ওষুধেই না সারলে, থানকুনি পাতা সিদ্ধ করে তার জল লাগালে সেরে যায়। সদ্য ক্ষতে থানকুনি পাতা বেটে লাগালে, ক্ষত নিরাময় হয়ে যায়।
৭. থানকুনি পাতা চুল পড়া আটকে দেয়। এমনকি নতুন চুল গজাতেও সাহায্য করে।
৮. বয়স বাড়লেও, যৌবন ধরে রেখে দেয় থানকুনি পাতার রস। প্রতিদিন একগ্লাস দুধে ৫-৬ চা চামচ থানকুনি পাতার রস মিশিয়ে খেলে, চেহারায় লাবণ্য চলে আসে। আত্মবিশ্বাসও বেড়ে যায়।
৯. দাঁতের রোগ সারাতেও থানকুনির জুড়ি মেলা ভার। মাড়ি থেকে রক্ত পড়লে বা দাঁতে ব্যথা করলে একটা বড় বাটিতে থানকুনি পাতা সিদ্ধ করে, তারপর ছেঁকে নিয়ে সেই জল দিয়ে কুলকুচি করলে উপকার পাওয়া যায় চটজলদি।
১০. যদি মুখ মলিন বা লাবণ্যতা কমে যায় তবে ৫-৬ চা চামচ থানকুনি পাতার রস দুধ দিয়ে খেতে হবে। নিয়মিত করলে উপকার পাবেন। নিয়মিত থানকুনি পাতার রস খেলে ত্বকের সতেজতা বাড়ে।
১১. অপুষ্টির অভাবে, ভিটামিনের অভাবে চুল পড়লে পুষ্টিকর ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবারের পাশাপাশি ৫-৬ চা চামচ থানকুনি পাতার রস দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খেতে হবে।
১২. পেটের দোষ বা মলের সঙ্গে শ্লেষ্ণা গেলে, মল পরিষ্কার ভাবে না হলে, পেটে গ্যাস হলে, কোনো কোনো সময় মাথা ধরা এসব ক্ষেত্রে ৩-৪ চা চামচ থানকুনি পাতার গরম রস ও সমপরিমাণ গরুর কাঁচা দুধ মিশিয়ে খেতে হবে। নিয়মিত খেলে উপকার পাবেন।
১৩. স্মরণশক্তি বৃদ্ধির জন্য আধা কাপ দুধ, ২-৩ তোলা থানকুনি পাতার রস ও এক চা চামচ মধু মিশিয়ে খেতে হবে।
১৪. ঠাণ্ডায় নাক বন্ধ হলে, সর্দি হলে থানকুনির শিকড় ও ডাঁটার মিহি গুঁড়ার নস্যি নিলে উপকার পাওয়া যায়।
১৫. অল্প পরিমাণ আমগাছের ছাল, আনারসের কচি পাতা ১টি, কাঁচা হলুদের রস, ৪/৫ টি থানকুনি গাছ শিকড়সহ ভাল করে ধুয়ে একত্রে বেটে রস করে খালি পেটে খেলে পেটের পীড়া ভাল হয়। ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এটা আরো বেশি কার্যকর।
১৬. আধা কেজি দুধে ১ পোয়া মিশ্রি ও আধা পোয়া থানকুনি পাতার রস একত্রে মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে ১ সপ্তাহ খেলে গ্যাস্ট্রিক ভাল হয়।
১৭. বেগুন অথবা পেঁপের সাথে থানকুনি পাতা মিশিয়ে শুকতা রান্না করে প্রতিদিন ১ মাস খেলে হজম শক্তি বৃদ্ধি পায়।
১৮. প্রতিদিন সকালে খালিপেটে ৪ চা চামচ থানকুনি পাতার রস ও ১ চা চামচ মধু/ মিশিয়ে ৭ দিন খেলে রক্ত দূষণ ভাল হয়।
১৯. জ্বর ও আমাশয়ে থানকুনি পাতার রস গরম করে ছেঁকে খেলে উপকার হয়।
২০. বাচ্চাদের কথা পরিষ্কার না হলে এক চামচ থানকুনি পাতার রস গরম করে প্রতিদিন খাওয়ালে কথা স্পষ্ট হবে।
২১. ঠাণ্ডা লাগলে ২০-২৫ ফোঁটা থানকুনির রসের সঙ্গে মধু মিশিয়ে খেলে উপকার পাবেন।
২২. প্রতিদিন সকালে থানকুনির রস ১ চামচ, ৫/৬ ফোঁটা হলুদের রস (বাচ্চাদের লিভারের সমস্যায়) সামান্য চিনি ও মধুসহ ১ মাস খেলে লিভারের সমস্যা ভাল হয়।
২৩. মূলসহ সমগ্র গাছ নিয়ে সিদ্ধ করে সেই জল দিয়ে দূষিত ক্ষত ধুলে ক্ষত ভালো হয়ে যাবে।
২৪. কোথাও থেঁতলে গেলে থানকুনি গাছ বেটে অল্প গরম করে আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে প্রলেপ দিলে উপকার পাবেন।
২৫. থানকুনি পাতা বেটে ঘিয়ের সঙ্গে জ্বাল দিয়ে ঠাণ্ডা করে তা সাধারণ ক্ষত স্থানে লাগাতে হবে।
হাজারো গুণের সমাবেশ ঘটেছে থানকুনি পাতায়। থানকুনি পাতার ব্যবহার শরীর সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। সেই সাথে পরিবেশও স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করি। তাই প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় থানকুনি পাতা রাখার চেষ্টা করুন।
ছোট্ট এই উদ্ভিদটি বাড়ির ছাদে কিংবা বারান্দায় টবেও চাষ করা যায়। নানা রোগের ডাক্তার থানকুনি! ফলে চিকিৎসক থাকছে আপনার কাছেই।
রুনা নাথ(runa@krishijagran.com)
Share your comments