ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তির ব্যবহারের সাথে সাথে ক্যানসার সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে আর তাতে আক্রান্ত হচ্ছে লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষ। লাঙ, প্রোস্টেট, কোলেস্টেরল এবং ব্রেস্ট ক্যানসার হল বর্তমান সময়ে সবথেকে ক্ষতিকর এবং এই সমস্ত ক্যানসারে আক্রান্ত এবং মারা যাওয়া রোগীর অর্ধেকের বেশী এই সমস্ত ক্যানসারে আক্রান্ত। অস্ত্রপ্রচার, কেমো থেরাপী, রেডিও থেরাপী এবং কিছু হরমোনাল থেরাপি হল বর্তমানে ক্যানসারের জন্য প্রচলিত চিকিৎসা। তবে এগুলির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া খুবই বেশী এবং রোগীর স্বাস্থ্যের পক্ষ্যে খুবই ক্ষতিকর।
বর্তমানে প্রচলিত চিকিৎসা গুলির সাথে সাথে ঐতিহ্যবাহী ‘হার্বাল’ থেরাপীও ব্যবহৃত হচ্ছে ক্যাসারের বিরুদ্ধে। ঔষধের সাথে সাথে ক্যানসার প্রতিরোধী ভেষজের ব্যবহার জনপ্রিয় হচ্ছে যেহেতু এগুলির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে এনং রোগীর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকরও নয়।
Dysoxylum binectariferum নামক একটি গাছ ক্যানসার প্রতিরোধে চিকিৎসা শাস্ত্রে ব্যবহৃত হয়। গাছটিতে রোহিটুকিন (Rohitukin) নামক এক প্রকার ফ্ল্যাভোনয়েড থাকে যেটা সরাসরি ক্যানসার কোশের উপর কাজ করে এবং সেই সমস্ত প্রোটিন ও অন্যান্য পদার্থকে আক্রমণ করে যারা ক্যানসার কোশকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাঁচতে সাহায্য করে। ভারতবর্ষে এই গাছটি পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, পশ্চিমঘাট পর্বতমালা, আন্নামালাই ও উত্তর কানাড়া অঞ্চলে ব্যপক পরিমানে জন্মায়।
Dysoxylum binectariferum একটি বৃক্ষ জাতীয়, পর্ণমোচী, লম্বা কান্ড এবং অসংখ্য ডালপালা যুক্ত গাছ। মধ্যবয়স্ক গাছের কান্ড বাদামী রঙের, খুব শক্ত, রুক্ষ এবং স্থুল প্রকৃতির হয়। গাছটির ঔষধী গুন বিচার করে এটিকে কৃষি বনায়নের আওতাভূক্ত করার চিন্তা গবেষকদের মাথায় এসেছে।
সারা বিশ্বব্যাপী ঔষধী গাছের গুনাগুন সম্পর্কে মানুষ সচেতন হওয়ার সাথে সাথে বিপুল পরিমানে এই সমস্ত গাছের চাহিদা বাড়ছে এবং তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এই গাছের ছেদন, যার ফলে গাছগুলি আজ প্রায় ধ্বংসের পথে। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে গাছগুলি সংরক্ষণের সবথেকে ভালো বিকল্প হল এগুলির পুনঃসৃজন করা যাতে গাছগুলির চাহিদা যেমন মেটানো যাবে তেমনই মূল্যবান গাছগুলির সংরক্ষণও হবে।
কৃষি বনায়নে এই সমস্ত গাছের সংযোজন কৃষকদের চলতি ফসলের সাথে সাথে বাড়তি আয়ের সুযোগ করে দেবে। ঔষধি গাছগুলি কৃষি জমির আল বাঁধের উপর কিংবা অন্তর্বর্তী ফসল হিসেবে চাষ করা যাবে। ক্রমবর্ধমান চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে যেহেতু গাছগুলির অস্তিত্ব সংকটে পৌঁছেছে, সেহেতু এই সব গাছের সংযোজন কৃষি বনায়নে আয় বাড়ার সাথে সাথে চিহিদা ও মেটাতে সক্ষম হবে যা বর্তমান সময়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর মতে প্রাণহানিকারক রোগগুলির মধ্যে ক্যানসার বিশ্বে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। শুধু তাই নয় পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৮ সালে ৯.৬ মিলিয়ন রোগীর মৃত্যুও হয়েছে শুধুমাত্র ক্যানসার এর কারণে। ক্যানসার এর কারণে মৃত্যুর ৭০ শতাংশই হয় মধ্যবর্তী এবং নিম্নবর্তী আয় সম্পন্ন দেশে। ক্যানসারের কারণে মৃত্যুর এক তৃতীয়াংশই হয় ৫টি ব্যবহারিক ও খাদ্যাভাসের ভূল থেকে। যেমন – অতিরিক্ত ওজন বাড়ানো, কম পরিমানে ফল এবং সবজি সেবন, শিরিরীক পরিশ্রমের অভাব, তামাকের সেবন এবং অ্যালকোহলের ব্যবহার।
ক্যানসারের চিকিৎসায় বর্তমানে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপায় গুলির সাথে সাথে সম্পূর্ণ ভেষজের উপর নির্ভরশীল আয়ুরাবেদিক, সিদ্ধা, ইউনানি, অতি পরাতন ইরানি চিকিৎসা, ইসলামিক চিকিৎসা, চিরাচরিত চাইনিজ ও কোরিয়ান চিকিৎসা, আফ্রিকার আরুবা চিকিৎসা এবং চিরাচরিত আফ্রিকান চিকিৎসা বিদ্যাও ব্যবহৃত হচ্ছে। এই সমস্ত চিকিৎসা বিদ্যার মূলই হল গাছ এবং গাছের নির্যাস ব্যবহার করে ঔষধ তৈরী করা। বর্তমানে ক্যানসারের জন্য ব্যবহৃত ঔষধগুলির বেশীর ভাগই মূলত প্রাকৃতিক উৎস্য থেকে প্রাপ্ত । ভেষজ উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত ঔষধগুলির কম পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এবং অধিক কার্যক্ষমতাই এগুলিকে গবেষকদের কাছে আগ্রহের প্রধান কারণ তৈরী করেছে। প্রাকৃতিক গাছ গাছালি থেকে কিছু অ্যালকালয়েড, ফ্ল্যাভোনয়েডস, ফ্যাভোনস, টারপিনয়েড এবং পলিফেনল নির্যাস আলাদা করে ঔষধ তৈরীতে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিছু প্রধান অ্যালকালয়েড যা ভেষজ উদ্ভিদ থেকে পাওয়া গেছে এবং যেগুলি অ্যন্টি ক্যান্সার ধর্ম বহন করে এমন কিছু অ্যালকালয়েড হল Taxol এবং Campothecin যা ১৯৬০ খ্রীষ্টাব্দে আবিস্কৃত হয়েছে। আরও কিছু প্রয়োজনীয় অ্যালকালয়েড যেগুলি পাওয়া গেছে তা হল Harringtonine, acronycine, thalicarpine, usambarensine, ellipticine, matrines এবং rohitukine.
লেখক: শাওলী বৈদ্য ও ড. বেনুকর বিশ্বাস, কীটতত্ত্ব বিভাগ, বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ব বিদ্যালয়।
রুনা নাথ(runa@krishijagran.com)
Share your comments