আরটিজি অর্থাৎ Roof Top Gardening এখন বহুল প্রচলিত এক শব্দ। মফঃস্বলে ‘RTG’-র চল ক্রমবর্ধমান। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বলগ্নায় আরটিজি থেকে প্রতি বছর প্রাপ্ত সবজীর পরিমাণ ১২০০০ টন-এরও বেশী, যা শস্যের ৭৭% চাহিদা পূরণ করে। এই সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাসভবনের ছাদে এই অরণ্যায়ন শহর এবং তার কাছাকাছি অঞ্চলগুলির মধ্যে জীববৈচিত্র্যের সংযোগ নিবিড় করে। এর ফলে অনায়াসেই ০.৬৭ Km/Km2 ঘনত্বের সাথে ৯৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যেরও বেশী অঞ্চল জুড়ে সবুজের এক অবকাঠামো গড়ে উঠবে (ফ্রান্সেসকো এট আল, ২০১৪ অনুযায়ী)।
- আরটিজির বেশ কয়েকটি সাফল্যের কাহিনীর মধ্যে প্রকৃষ্ট উদাহরণ রূপে নাম আছে আমাদের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের। বাংলাদেশের প্রশাসন বিভাগ (Department of Public Administration), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা শহরে ২০০৪ সালে খাদ্য সুরক্ষার জন্য শহরে কৃষিক্ষেত্রের কৌশল হিসাবে সম্ভাবনা নির্ধারণের জন্য আরটিজির একটি কর্মসূচি পরিচালনা করে। তারা ঢাকা শহরে ভবনের ছাদে উদ্যান স্থাপন করে সেখানে বিভিন্ন ফলমূল, শাকসবজী, আলংকারিক উদ্ভিদ এবং অবলম্বিত বিভিন্ন সবজি (লাউ, কুমড়ো প্রভৃতি) রোপণ করেন। যেহেতু, আরটিজি পরিবারের একটি অতিরিক্ত আয়ের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে, সেহেতু বলা যায় খন্ডকার এট আল, ২০০৪ অনুযায়ী) এই প্রক্রিয়া শহরের বাসকৃত অপেক্ষাকৃত দরিদ্রদের জন্য, তাদের দারিদ্র্য বিমোচনের কৌশল হিসাবে কাজ করে।
- ইতালির বলগ্না শহরে বাসভবনের শীর্ষে উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ নির্ধারণের জন্য একটি কেস সমীক্ষা চালানো হয়। এই সমীক্ষাটিতে আরটিজির শহরের খাদ্য সুরক্ষায় অবদানের পাশাপাশি নগরের জীববৈচিত্র্যে এবং বাস্তুতন্ত্র পরিষেবায় অবদানের সম্ভাব্য সুবিধাগুলিও পরিলক্ষিত করা হয়।
পদ্ধতিগুলি ছিল নিম্নরূপ –
১) শীর্ষে স্থাপিত উদ্যানের (আরটিজি) মাটিবিহীন পদ্ধতিগুলির সম্ভাব্য উত্পাদনশীলতার পরীক্ষা।
২) সমগ্র সমতল ছাদ এবং ছাদ-চত্বর সনাক্তকরণ এবং আরটিজিতে রূপান্তরিত হতে পারে এমন সম্ভাব্য পৃষ্ঠগুলির আয়তন নির্ধারণ।
৩) জনসংখ্যা এবং খাদ্যশস্য চাহিদার ভিত্তিতে শহরের উদ্ভিজ্জ প্রয়োজনীয়তার সনাক্তকরণ।
৪) স্থানীয় আরটিজি থেকে উত্পাদিত প্রয়োজনীয় সবজীর অনুপাতের গণনা।
৫) শহুরে সবুজের অবকাঠামোগত (গ্রীন ইনফ্রাস্ট্রাকচার/জিআই) বর্ধিত ক্ষেত্রের সাথে যুক্ত অন্যান্য সুবিধাগুলির (গ্রীন করিডোর তৈরির মাধ্যমে শহুরে জীববৈচিত্র্যের উন্নতি এবং কার্বন সিকোস্স্ট্রেশনের প্রাক্কলন) সনাক্তকরণ।
২০১০ সালে, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং একটি অলাভজনক সংস্থার উদ্যোগে প্রথম ইতালির বলগ্না শহরে ২১৬ m2 এলাকায় বাসভবনের শীর্ষে উদ্যান নির্মাণ করা হয় আরটিজি পরীক্ষার উদ্দেশ্যে। গবেষকরা ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত একটি পরীক্ষা করেছিলেন। এই উদ্যানে লেটুস, কালো বাঁধাকপি, চিকোরি, টমেটো, মরিচ, তরমুজ ইত্যাদি উৎপন্ন হয়। তারা অনুমান করেন যে, এই উদ্যান থেকে প্রতি বছর তিন টনেরও বেশি শাকসবজী পাওয়া যেতে পারে। তারা আরও অনুমান করেন যে, যদি ০.৮২ Km2 জায়গা উপলব্ধ হয়, তবে এই উদ্যানগুলি থেকে প্রায় ১২,৫০০ টনেরও বেশী শাকসবজী উত্পাদিত হবে। এর অর্থ এই যে, শহরের মোট জনগণের চাহিদার তথ্যের ভিত্তিতে আরটিজি থেকে প্রাপ্ত ফসল ৭৭% শাকসবজীর প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে পারে। সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল, আরটিজি প্রতি বছর আনুমানিক ৬২৪ টন কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) শোষণ করতে পারে (ওরসিনি এট আল, ২০১৪)।
- ইতালির রোমে আরটিজিতে উৎপাদিত ২৬৩১ টি ফল এবং শাক সবজীতে সেচ প্রদানের জন্য বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করে একটি সমীক্ষা পরিচালিত হয় ফ্ল্যাভিও এট আল (২০১৭) । বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত ভূগর্ভস্থ তথ্য থেকে উদ্ভিদে সেচের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অনুভব করা যায়। এই সমীক্ষায় পার্শ্ববর্তী বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করে উদ্যানে সেচ প্রদান করা হয়। এতে দেখা যায় যে, ১৯% এবং ৩৩% উদ্যানে যথাক্রমে নিম্ন ও উচ্চ সেচ দক্ষতার জন্য জল স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে। অবশিষ্ট উদ্যানে উপলব্ধ বৃষ্টির জল ব্যবহার করে, ২২% (নিম্ন দক্ষতা) এবং ৪৪% (উচ্চ দক্ষতা) জলের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করা যায়, যার ফলে প্রচলিত জলের উৎসের ব্যবহার হ্রাস পেতে পারে।
- মিলান সিটি কাউন্সিলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক অধিদপ্তর ২০০৪ সালে ডাকার সিটি কাউন্সিলের সাথে একটি অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে, সেনেগালিস-এর রাজধানী এবং পার্শ্ববর্তী শহর পিকাইনের স্বল্প আয়ের অঞ্চলে ক্ষুদ্র-উদ্যানগুলিকে উন্নত করার জন্য এফএও (FAO) সহায়তা প্রদান করে। এর ফলে ওই এলাকার জনগন মাইক্রো গার্ডেন বা আরটিজি শুরু করতে ব্যাপক উৎসাহিত হন। ফলস্বরূপ ৪০০০ এরও বেশি নগরবাসী, (এদের বেশিরভাগ মহিলা) মাইক্রো গার্ডেন শুরু করেছিলেন, যা প্রতি বছর গড়ে ৩০ Kg/m2 শাকসবজী উত্পাদন করে, যা পরিবারের চাহিদা মেটাতে এবং বিক্রয়ের জন্য, উদ্বৃত্ত সরবরাহের জন্য যথেষ্ট।
- গুঞ্জন গুপ্ত এবং প্রদীপ মেহতা ২০১৭ সালে দিল্লি নগরীর ১২ টি বাসভবনের শীর্ষে উদ্যানরোপণের একটি গবেষণা করেছিলেন। তারা পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, আরটিজি ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে। তারা বাস্তুতন্ত্রের পরিষেবা সরবরাহের ক্ষেত্রে সহায়তা করে, নগরীর জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ করে এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা হ্রাস করে। আরটিজি চাষাবাদ পদ্ধতির একটি বিকল্প কৃষিক্ষেত্র, যা প্রাকৃতিক চক্র এবং জৈবিক মিথস্ক্রিয়ার জন্য অধিক প্রতিক্রিয়াশীল। শহুরে কৃষিতে মনোনিবেশ করার অন্যতম কারণ, শহরগুলিতে আরটিজির নগর উন্নয়নের একটি স্থায়ী উপাদান। কারণ নগরীর পরিবেশের অপব্যবহার ও অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে যে পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়, তা আরটিজি অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করে পরিবেশে এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
Share your comments