
বর্তমান আধুনিক যুগে যেমন জনসংখ্যা বাড়ছে তেমন বাড়ছে খাদ্যের চাহিদা | এই ব্যাপক চাহিদাপূরণের জোগান বাড়াতে ফসল উৎপাদন হচ্ছে কৃত্রিম উপায়ে | কার্বাইডে পাকানো ফল, হাইব্রিড শাক-সব্জি, ব্রয়লার মুরগি ইত্যাদি | এই কোনো কিছুই আদতে আমাদের শরীরের জন্য ভালো নয় | অতিরিক্ত ফলন বাড়াতে দিনের পর দিন ক্ষতিকর পেস্টিসাইডসের বহুল ব্যবহার বাড়ছে। ফলত, খাবারের এই কৃত্রিমতায় পুষ্টিগুণ কমছে যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর| তাই, কৃষিকাজে আবারও অগ্রগতি হয়ে দাঁড়াচ্ছে জৈব কৃষি বা অর্গ্যানিক ফার্মিং | এই জৈবিক কৃষিকাজে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকবন্ধুদের মধ্যে |
জৈব কৃষিকাজ কি (What is Organic Farming)?
কোনও রকম কৃত্রিম ও রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার না করে জৈব পন্থা অবলম্বন করে চাষবাস, ফলনই হল অর্গ্যানিক ফার্মিং। রোজকার আনাজপাতি, মাছ-মাংস, ডিম-দুধ সবই উৎপাদিত হতে পারে অর্গ্যানিক উপায়ে। সবচেয়ে বেশি চাহিদা অর্গ্যানিক উপায়ে চাষ করা ফল, আনাজ, হার্ব, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, মধু ইত্যাদির।
যেহেতু কোনও রাসায়নিক স্যারের ব্যবহার নেই, তাই সার বানাতে হবে প্রাকৃতিক উপায়ে। অর্গ্যানিক ফার্মিংয়ের ভিত কিন্তু সারের উপরেই। ফার্মের পশু-পাখির বিষ্ঠা শুকিয়ে তা দিয়েই মূলত তৈরি হয় জৈব সার। এ ছাড়াও কচুরিপানা খুব ভাল সারের কাজ করে। তাই গাছের গোড়ায় কচুরিপানাও দেওয়া হয়ে থাকে। মাটি ছাড়া শুধু কচুরিপানা জমিয়েও তাতে করে ফেলা যায় পেঁপে গাছ। এই জৈব সারই হলো গাছের ফলন বৃদ্ধির আসল চাবিকাঠি | মাটির উর্বরতা বাড়াতে ব্যবহার করা হয় কেঁচোকেও। গাছের গোড়ায় যাতে অক্সিজেন পৌঁছায়, তার জন্য খুরপি দিয়ে মাটি খুঁড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু কেঁচো নিজেই এই কাজটা করে দেয়। গাছে পোকা লাগলেও নষ্ট হয় আনাজপাতি। অর্গ্যানিকে কিন্তু পেস্টিসাইড চলবে না। তাই ব্যবহার করা হয় নিম তেল। গোমূত্রও ব্যবহার করা হয় কীটনাশক হিসেবে। ফলে পোকাও ধ্বংস হয়, আবার ফসলের ক্ষতির সম্ভাবনা নেই |
জৈব কৃষিকাজ পদ্ধতি (Types of Organic Farming):
এই জৈব কৃষির পন্থাকে কাজে লাগিয়ে শাক-সব্জি, আনাজ, মাছ, মাংস প্রায় সব উৎপাদিত হয় | যেমন,
শাক (Herbs):
কুলেখাড়া,ধনে, নটে, লাল নটে, ব্রাহ্মী, গুলঞ্চ, কালমেঘ, পুদিনাও চাষ করা যেতে পারে এই উপায়ে। একসঙ্গে একাধিক হার্ব চাষ করা হয় সারি হিসেবে। এতে হার্ব তুলতে সুবিধে হয়। ব্রাহ্মী, কুলেখাড়া চাষ করা যায় জলেই। প্রথমে ছোট পাত্রে এবং পরে গাছ বড় হলে তা তুলে বড় পাত্রে রাখা হয়। এই গাছ থেকে তৈরি করা হয় নানা ভেষজ ঔষধ |
সব্জি (Vegetables):
একই জমিতে বছরে ২ বার, তিন বার ভিন্ন ফসল চাষ করা হয়। ধান তোলা হয়ে গেলে সেই জমিতেই চাষ হয় তৈলবীজ যেমন সর্ষে, সূর্যমুখী, তিল ইত্যাদি। আবার সরষে তোলার পরে ও ধান গাছ লাগানোর আগে করা হয় তিল চাষ। বাঁধাকপি, ফুলকপি চাষের ক্ষেত্রে জায়গা বেশি লাগে। কারণ প্রত্যেকটি চারা বা বীজের মাঝে ব্যবধান হবে এক হাত। আবার মুলোর সঙ্গে চাষ করা হয় লাল নটে শাক। মাটিতে চাষের প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেনের জোগান বাড়ে। কুমড়ো, পেঁপে, লাউ, বেগুনের ক্ষেত্রে ধৈর্য ধরতে হবে আনাজ বড় হওয়া পর্যন্ত। সাধারণত, জৈবিক উপায়ে ফলনের বৃদ্ধি হতে একটু দেরি হওয়ায় ধৈর্য রাখতে হবে, তবে সম্পূর্ণ বিষমুক্ত সব্জি উৎপন্ন হয় |
পোল্ট্রি (Poultry):
কোয়েল, মুরগি থেকে শুরু করে গরু প্রতিপালনও করা যায় এখানে। মুরগি ২ টি ভাগে প্রতিপালন করা হয়। একটি ডিমের জন্য, অন্যটি মাংসের জন্য। কোয়েলের ক্ষেত্রেও তাই। অর্গ্যানিক দুধের চাহিদা প্রচুর। আবার গরুর দুধ থেকে ঘি, মাখন যেমন তৈরি করা যায়, তেমনই গোবর ব্যবহার করা হয় জৈব সার তৈরি করতে এবং গোমূত্র কীটনাশক হিসেবে।
মাছ (Fish farming):
পুকুরেই চাষ করা হয় তেলাপিয়া, রুই, কাতলা, কই ইত্যাদি মাছ। পানাও ছড়িয়ে থাকে পুকুরের উপরে যাতে তারা খাবার পায়। অন্য দিকে আলাদা পুকুরে চাষ করা হয় চিংড়ির। জিওল মাছ বা বড় মাছ ধরা হয় বেড় জালে।
জৈব কৃষিকাজে বর্জ্যের ব্যবহার (Waste management):
অর্গ্যানিক চাষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হল বর্জ্যের ব্যবহার। জৈব বর্জ্য সহজেই প্রকৃতিতে মিশে যায়। ফলে তা দিয়ে সার তৈরিও সহজ। কিন্তু শহরাঞ্চলে বর্জ্যের অনেকটাই প্লাস্টিক, সে ক্ষেত্রে ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট জরুরি। এমন অনেক সংস্থা আছে, যারা প্রত্যেক দিন বর্জ্য সংগ্রহ করে। তার পরে তা থেকে কৃত্রিম এবং প্রাকৃতিক বর্জ্য পৃথক করা হয়। প্লাস্টিক জাতীয় বর্জ্য আলাদা করে তা হস্তশিল্পের কাজে লাগানো হয়। অন্য দিকে কিচেন ওয়েস্ট অর্থাৎ আনাজপাতির খোসা, মাংসের ছাঁট ইত্যাদি পচনশীল বর্জ্য থেকে বায়োগ্যাস এবং সার তৈরি করা হয়। আবার, এই সার চলে যায় বিভিন্ন অর্গ্যানিক ফার্মে।
আরও পড়ুন - Intercropping Agriculture: কৃষিক্ষেত্রে মিশ্র চাষের গুরুত্ব ও সুবিধা
বাড়িতে কিভাবে জৈবিক উপায়ে চাষ করা যায় (Organic farming at home):
বাড়িতেই খুব সময় উপায়ে অর্গ্যানিক চাষ করে সব্জি উৎপাদন (Organic vegetables cultivation) করতে পারেন | এই চাষের জন্য স্বল্প জায়গা ও জলের ব্যবহার প্রয়োজন। বড় ড্রামের গায়ে সমান ব্যবধানে চৌকো করে চিরে নিন। প্রত্যেকটি চেরা জায়গায় একটি করে চারা লাগান। একটি ড্রামেই জন্মাবে একাধিক গাছ। আবার, উল্লম্ব ভাবে একের পর এক ট্রে বা টবে চাষ করতে পারেন থানকুনি, ধনেপাতা, পুদিনা পাতা | বাড়ির বর্জ্য থেকে সার তৈরি করে গাছের গোড়ায় দিতে পারেন। ফলে, আপনার বাড়ির বর্জ্য নষ্ট হবেনা আবার সব্জিও উৎপাদন হবে |
আরও পড়ুন - Green House Farming: গ্রিন হাউজ চাষ পদ্ধতির বিশেষত্ব ও সুবিধা
Share your comments