
বাংলার মানুষের খাওয়ার পরিধি বেশ বিস্তৃত। আমিষের সঙ্গে দেশি বিদেশী সবজি, ফলমূল চেখে দেখায় দেখায় পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের উৎসাহের শেষ নেই। প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে দেশি বিদেশী বিভিন্ন চাষবাসেও মেতে উঠছেন বঙ্গের কৃষকরা। মাখনা। গ্রামীণ বাংলাতেই চাষ হওয়া এই জলজ খাদ্যফসল সম্বন্ধে এখনকার বাঙালি কতটা ওয়াকিবহাল তা নিয়ে উঠতেই পারে প্রশ্ন! দেশি বিদেশী বিভিন্ন দামি জাতের ফল-সবজি খেলেও গ্রাম বাংলার প্রান্তিক জলাশয়ে জন্মানো এই খাদ্যফসল বাঙালির ঘরে ঘরে এখনও তেমন ভাবে পৌঁছে যায়নি। পানিফলের মতনই জলাভূমির এই ফসল গবেষকদের গবেষণায় অত্যন্ত পুষ্টিকর হিসাবে বিবেচিত হয়েছে।
মালদার চাঁচল ও হরিশ্চন্দ্রপুর মাখনার চাষের জন্য বিখ্যাত। মাখনার বীজ থেকে তৈরি খই বাজারে প্যাকেটজাত হয়ে বিক্রিও হয়। চাষি ভাইরা এই চাষের পরিকল্পনা করে দেখতে পারেন। অত্যন্ত স্বল্প খরচের এই চাষ ভবিষ্যতে সুদপ্রসারী লাভ দেবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
জলাভূমিতে জন্ম নেওয়া মাখনা চারাগাছের কন্দ থেকে একাধিক শাখা বেরিয়ে আসে। একটি মাখনা গাছে কম করে ১৫ থেকে ২০ টি ফুল হয়। মাখনার ফল গোলাকৃতি ও কাঁটা বিশিষ্ট যা অনেকটা কমলালেবুর মতন দেখতে। মাখনা ফলের মধ্যে একাধিক চেরি ফলের মতন দেখতে গোলাকৃতি কালো বর্ণের শক্ত বীজ থাকে।
চাষ করার নিয়মাবলী (Cultivation Procedure)
বর্ষার শুরুর দিক এই চাষ করার উত্তম সময়। পুকুর পরিষ্কার করে দু’তিনটি চাষ দিয়ে নিয়ে মই মেরে জমি সমান করে নিতে হবে। আষাঢ় মাস নাগাদ মাখনার চারা গাছগুলি শিকড়সুদ্ধ কন্দ সহ মাটিতে পুঁতে দিতে হবে। গাছ বেড়ে উঠবে এক মাস যেতে না যেতেই। ছোট ছোট কাঁটাতে এইসময় গাছ ভরে ওঠে। কয়েকমাস পরেই পুকুর ছেয়ে যাবে মাখনা গাছে।
সার প্রয়োগ (Fertilizer)
জমির উর্বরতা কম থাকলে জমি বানানোর সময় বিঘা প্রতি দেড় থেকে দুই টন গোবর সার ও ৪-৬ কেজি ইউরিয়া, ২০-২৫ কেজি সিঙ্গল সুপার ফসফেট এবং ৪-৫ কেজি মিউরিয়েট অফ পটাশ জমিতে দিলে মাখনার ফলন ভালো হয়। গাছ লাগানোর ৪২ থেকে ৪৫ দিনের মাথায় ৩-৪ বার গাছে লিটার জলে হাফ গ্রাম জিঙ্ক ঘটিত অণুখাদ্য স্প্রে করলে ফলনের মান ভালো হয়। মনে রাখতে হবে এই স্প্রে ১৫ থেকে ২০ দিন বাদে বাদে করতে হবে।
আগাছা দমন (Weed Control)
মাখনা চাষের সুবিধা হল এই চাষে আগাছা তেমন ভাবে পরিলক্ষিত হয় না। কিন্তু শ্যাওলা, কচুরিপানা পুকুরে দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে তা সাফ করা উচিত।
রোগ-পোকা ( Pest and disease control)
মাখনাতে পামরি পোকার আক্রমণ বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করা যায়। এই পোকার থেকে ফসলকে রক্ষা করতে হলে নিমতেল এক মিলি হারে প্রতি লিটার জলে গুলে নিয়ে স্প্রে করা হলে ভালো হয়। মাখনা গাছের পক্ষে গোড়া পচা, গুল্ম পচা রোগ বিপজ্জনক! মাখনা বীজ থেকে ছড়ানো এই রোগ থেকে চারাকে বাঁচাতে হলে প্রথমেই তা শোধন করিয়ে নেওয়া দরকার।
আরও পড়ুন: Young Farmer Forum : চাষবাসের কৌশল হাতে কলমে শিখতে ইন্ডিয়ান ইয়ং ফারমার ফোরামই ভরসা
বীজ তোলা (Harvesting)
মাখনা গাছ পচতে থাকে শীত পড়তে না পড়তেই। এইসময় ফলত্বক পচে ওঠে এবং কালো রঙের বীজ গাছের গোড়ায় পড়ে যায়। বীজ তোলার সময় স্বাভাবিক ভাবেই বীজের গায়ে কাদা লেগে থাকবে। তাই বীজগুলো সতর্কতার সঙ্গে ধুয়ে নিতে হবে। এবার সূর্যালোকে ভালো ভাবে বীজগুলি শুকিয়ে নিতে হবে। বীজগুলি শুকানোর পর কড়াই গরম করে বালিতে ভেজে নেওয়ার পর মেঝেতে ছড়িয়ে কাঠের পাটাতন দিয়ে বাড়ি মারলেই বীজত্বক ফেটে মাখনার খই বেরিয়ে আসে।
মিষ্টি স্বাদের মাখনা দিয়ে বিভিন্ন জিভে জল নিয়ে আসা খাবার বানানো যায়। বাঙালির অন্যতম প্রিয় খাবার ফুচকাতেও এই মাখনা ব্যবহার করা হয়। চাষিভাইদের উদ্দেশ্যে বলাই চলে স্বল্প খরচের এই চাষ তাঁরা করে দেখতেই পারেন, আখেরে লাভ হবে তাঁদেরই।
Share your comments