সাধারণভাবে বললে যে কোন আচ্ছাদন দ্বারা মাটিকে আচ্ছাদিত করাকেই মালচিং বলে। আর মালচিং এর জন্য ব্যবহৃত উপকরণকে বলে মালচ। কেউ কেউ মালচকে ‘ঈশ্বরের কম্বল’ বলেও অভিহিত করে থাকেন। কারণ বন্য গাছ-পালার নিচে মালচ প্রাকৃতিকভাবেই গড়ে ওঠে। প্রাকৃতিক মালচ হিসেবে সাধারণত খড়কুটা, ঘাস, পাতা, ফসলের পরিত্যক্ত অংশ, কাঠের ছোট টুকরা বা বাকল প্রভৃতি ব্যবহৃত হয়। তবে কৃত্রিম মালচ হিসেবে কোন কোন কৃষক প্লাস্টিকের সিট ব্যবহার করেন। কিন্তু চাষে বাণিজ্য ও আধুনিকীকরণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্লাস্টিক মালচিং-এর ব্যবহার জনপ্রিয় হচ্ছে। এটি আধুনিক চাষাবাদের একটি উন্নত পদ্ধতি। এর ফলে ফসলের দ্রুত বৃদ্ধি হয়। তাছাড়া, ভাল ফলনের জন্য মাটি ঢেকে দিয়ে আবাদের অনুকুল পরিবেশ তৈরি করা হয়।
১) ফসলের ক্ষেতে আর্দ্রতা সংরক্ষণে মালচিং বিশেষভাবে উপকারী, কারণ এ প্রযুক্তি ব্যবহারে ফসল ক্ষেতের জলের সূর্যের তাপ ও বাতাসে দ্রুত উড়ে যায় না। ফলে জমিতে রসের ঘাটতি হয় না এবং সেচ লাগে অনেক কম। মালচিং ব্যবহার করলে জমিতে প্রায় ১০ থেকে ২৫ ভাগ আর্দ্রতা সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়।
২) মালচিং করার জন্য যেসব মালচ উপাদান ব্যবহার করা হয়, সেগুলো হলো জৈব ও অজৈব পদার্থ। উপাদানগুলো হলো-ধান বা গমের খড়, কচুরিপানা, গাছের পাতা, শুকনা ঘাস, কম্পোস্ট, ভালোভাবে পচানো রান্নাঘরের আবর্জনা ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
৩) গাছের গোড়া, সবজির বেড এবং ফলবাগানে গাছের গোড়া হতে এক থেকে দু’ইঞ্চি (২.৫০-৫.০ সে.মি) দূরে বিভিন্ন ধরনের মালচ ব্যবহার করা যেতে পারে। মালচিংয়ের কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন পদার্থ অবশ্যই ৫ সেন্টিমিটার (২ইঞ্চি) এর বেশি পুরু করে দেয়া ঠিক নয়।
৪) উল্লেখ্য যে, মালচিং পদার্থের পুরুত্ব বেশি হলে তা গাছপালার অপ্রয়োজনীয় মূল গজাতে সহায়তা করবে। এমনকি সঠিক মালচিং প্রয়োগে বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড়ের আক্রমণও রোধ করা যায়।
৫) শীতকালে মালচ ব্যবহার করলে মাটিতে প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা ধরে রাখা সম্ভব হয় এবং গরমকালে মাটি ঠান্ডা থাকে।
৬) সবচেয়ে বড় কথা মালচিং প্রযুক্তি ব্যবহার করলে জল লাগে অনেক কম। সেচের খরচ বাঁচে, লাভ হয় বেশি।
৭) পাহাড়ি এলাকা এমনকি টিলা, পাহাড়ের ঢালে বিশেষ করে লালমাটি এলাকায় স্বল্প খরচে মালচিং প্রযুক্তি ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। ফল গাছ বিশেষ করে লেবু, পেয়ারা, কাঁঠাল, আম, নারিকেল, কলা, কমলা, আনারস, বাতাবি লেবু, পেঁপে, আদা, হলুদ এসব গাছের গোড়ায় মালচিং দিয়ে সম্ভব হলে ১-২ সপ্তাহ পর একবার জল দিয়েও বেশি সময় রস সংরক্ষণ করা সম্ভব।
৮) পোকা নিয়ন্ত্রণ (Pest Management):
মালচিংয়ের ফলে পোকার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। নিমাটোড বা ফসলে কীটের আক্রমণ রোধ করে। প্রতিফলক মালচ পতঙ্গদের প্রতিহত করে।
৯) সার ব্যবহার হ্রাস : এই পদ্ধতি ব্যবহারে শিকড়ের কাছের স্থানে সার প্রয়োগ করার জন্য চাষে সার প্রয়োগের পরিমাণ ও সংখ্যাও অনেক কমে যায়। ফলে খরচে রাশ টানা সম্ভব হয়।
১০) দ্রুত অঙ্কুরোদ্গম: প্লাস্টিক শিট দিয়ে মাটি ঢেকে রাখার ফলে মাটির ঢাকা অংশের উষ্ণতা রাতে এবং শীতকালে পরিবেশের থেকে বেশি হয়। ফলে বীজ থেকে অঙ্কুরোদ্গম দ্রুত সম্পন্ন হয়।
মালচের রয়েছে নানাবিধ উপকারিতা। যেমন: মালচ বৃষ্টির জলের গতি হ্রাসের মাধ্যমে মাটির ক্ষয় রোধ করে এবং মাটির জল শোষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, গরম ও ঠান্ডায় মাটির তাপমাত্রায় নিয়ন্ত্রনে ইনসুলেটর হিসেবে কাজ করে, প্রায় বাষ্পীভবন ৪০ শতাংশ ইভারেশন হ্রাসের মাধ্যমে মাটিতে প্রচুর পরিমাণে জল ধরে রাখে, উচ্চ তাপমাত্রায় মাটি ফেটে যাওয়া এবং মাটির উপরিভাগে কঠিন স্তর সৃষ্টিতে বাধাদান করে মাটির ভঙ্গুরতা রক্ষার মাধ্যমে কর্ষণে সহায়তা করে, মাটিতে হিউমাস ও জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করে, মাটিতে আলো পৌছাঁনোর ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মাধ্যমে আগাছা বীজের অঙ্কুরোদগমে বাঁধার সৃষ্টি করে এবং অসমতল মালচ শামুক জাতীয় প্রাণিদের চলার পথে বাধা সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের তাড়াতে সহায়তা করে।
সীমাবদ্ধতা: কচুরিপানা, জৈবসার, খড় ইত্যাদির অপেক্ষা প্লাস্টিক মালচিং ব্যয়সাপেক্ষ। গ্রীষ্মকালে কালো বা মোটা প্লস্টিক ব্যাবহার করলে উষ্ণতা বেড়ে যায়। ফলে চারা পোড়া বা শুকিয়ে যাওয়ার লক্ষণ দেখা যেতে পারে।
সুব্রত সরকার
Related link - কম পরিশ্রমে বেশি লাভ করতে ধুতুরা চাষ (Datura Farming) করতে পারেন
লেবু চাষ (Lemon cultivation) করে কৃষক উপার্জন করতে পারেন ২ কোটি পর্যন্ত
বর্ষায় কলার নার্সারিতে (Banana Nursery) কৃষকেরা দেখতে পারেন লাভের মুখ
Share your comments