প্রশাসন এবং বিজ্ঞানের উৎসাহ যদি একসঙ্গে পাওয়া যায়, তাহলে চাষের যে কোনও ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে সোনার খনি। পশ্চিমবঙ্গে টার্কি চাষের বাড়বাড়ন্ত এরই প্রকৃষ্ট উদাহরণ। টার্কি চাষের উন্নতির ফলে গ্রামের মহিলারাও দেখেছেন লাভের নয়া রূপ।
দক্ষিণ ২৪ পরগণার বলরামপুরে টার্কি চাষ করেন প্রতিমা কয়াল। ৩৫ বছরের এই গৃহবধূ জানিয়েছেন, এই চাষের ফলে তাঁর বহু অপূর্ণ আশা পূর্ণ হয়েছে। জীবনটাকে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য স্বাধীন চিন্তাভাবনাও তিনি করতে পারছেন।
প্রতিমার স্বামী কাজ করেন ফ্যান তৈরির কারখানায় সামান্য মেকানিক হিসেবে। সেখান থেকে যা উপার্জন হয়, তাতে কোনও রকমে রান্নাঘরের উনুনটা জ্বালানো যেত। কিন্তু এই টার্কি চাষ তাঁর জীবনটাই পুরো পরিবর্তন করে দিয়েছে। এখন তাঁরও মনে হচ্ছে স্বামীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তিনিও সংসারের জন্য রোজগার করতে পারেন। কোনও কিছুই আজ আর অসম্ভব নয় প্রতিমার কাছে। মাত্র দু’বছর হল প্রতিমা টার্কি চাষ শুরু করেছেন। কিন্তু এরই মধ্যে তিনি যা লাভ দেখেছেন, তাতে সন্তানদের ভবিষ্যত তিনি গুছিয়ে ফেলতে পারবেন এই আশা রাখেন।
বাঁচার আশা দেখাচ্ছে টার্কি চাষ -
প্রতিমা শুধু একা নন, সরকারি মতে প্রায় একহাজার মানুষ বর্তমানে টার্কি পালনের সঙ্গে যুক্ত। যার মধ্যে আবার ৭০ শতাংশই মহিলা। ওয়েস্ট বেঙ্গল লাইভস্টক ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিঃ (ডব্লুবিএলডিএস)-এর মার্কেটিং-এর প্রধান ডঃ সুদীপ সাহু জানিয়েছেন, বর্তমানে সরকার আধা-শহুরে বা গ্রামের মানুষদের টার্কি চাষের জন্য অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে। স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে উৎসাহী মানুষদের ডেকে তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে মাত্র একদিন বয়সের টার্কির বাচ্চা। যার মূল্য ৮৫ টাকা। এই টার্কির বাচ্চাটিকেই বাড়ির উঠোনে পালন করার দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। সাহু জানিয়েছেন, এই টার্কির বাচ্চা তাঁরা পরবর্তী সাত মাস ধরে পালন করছেন। যখন সেটি পূর্ণ মাত্রায় বড় হচ্ছে অর্থাৎ ৬-৭ কেজি ওজন হচ্ছে, তখন এটিকে কিনে নেওয়া হচ্ছে ওজন প্রতি ২৫০ টাকা দিয়ে। এরপর সেগুলিকে কেটে সরকার দ্বারা পরিচালিত রিটেল স্টোরে পাঠানো হচ্ছে কিংবা রেস্তোরাঁ বা হোটেলে।
আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল হতে নিজেরাই তৈরি করেছেন এসএইচজি -
প্রতিমা জানিয়েছেন, এই টার্কি চাষে তাঁর সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন আরও পাঁচজন মহিলা। এঁরা প্রত্যেকে ২০১৭ সাল থেকে দুটি সেলফ হেল্প গ্রুপ (এসএইচজি)-এর সদস্য। সরকার তাঁদেরকে প্রথমে ২০টি বাচ্চা দিয়েছিল। বাড়ির পেছনে শেড তৈরি করে সেখানেই বাচ্চাগুলির প্রতিপালন করছিলেন তাঁরা। ছ’মাস পর সেগুলিকে বড় করে প্রতিমারা সরকারের হাতে তুলে দেয়। পরিবর্তে যা টাকা আসে তাতে দেখা যায়, বাচ্চাগুলির জন্য যা খরচ হয়েছে, তা বাদ দিয়েও হাতে ২৮০০০ টাকা পড়ে রয়েছে। এই উপরি রোজগার তাঁদেরকে আরও এই কাজে উৎসাহিত করে।
বলরামপুরে মহিলাদের এই টার্কি চাষে উদ্বুদ্ধ করার পেছনে রয়েছেন আরও এক গৃহবধূ মমতা নাডু। ৪৮ বছরের এই গৃহবধূ জানিয়েছেন গ্রামের মেয়েদের আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল করতে চারটি এসএইচজি তৈরি করা হয়। কিন্তু কোনও ব্যবসাতেই লাভের মুখ দেখছিলেন না ওই মহিলারা। শেষে এক ব্যাঙ্কের আধিকারিক মমতার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সেই সঙ্গে একটি সেন্টারও যাঁরা দীর্ঘদিন এই টার্কি চাষ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাচ্ছেন। প্রথমে দু’টি এসএইচজি থেকে ছ’জন মহিলা টার্কি চাষে যোগদান করেন। তাঁদের সাফল্যই গ্রামবাসীদের উৎসাহিত করে। এসএইচজি-গুলির মহিলারা ধীরে ধীরে এই টার্কি-চাষে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। দেখা যায়, সবজি বিক্রেতারাও সবজি বিক্রির পাশাপাশি বাড়ির পিছনে শেড তৈরি করে টার্কির প্রতিপালন করতে শুরু করেছেন।
টার্কিচাষের মাস্টারমাইন্ড একটি বৈজ্ঞানিক সেন্টার -
২০১৬ সালে শস্য শ্যামলা কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিকরা টার্কিচাষের অভিনব পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার প্রচেষ্টা শুরু করেন। প্রথমে ছ’টি এসএইচজি-এর সঙ্গে কাজ শুরু হয়। এসএইচজি-এর সদস্যদের টার্কিচাষের প্রশিক্ষণ দেন। শস্য শ্যামলা কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞ ডঃ সর্বস্বরূপ ঘোষ জানিয়েছেন, ব্যাঙ্কের থেকে লোন নিয়ে ২৫০টি টার্কির বাচ্চা কেনেন তাঁরা। এরপর তারপর পরীক্ষা নিরীক্ষা চালান। ২০১৭ সালে বলরামপুর গ্রামবাসীদের সঙ্গে কাজ করা শুরু করেন। খরচ কমাতে টার্কিদের আজোলা খাওয়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, আলাদা করে চিকিৎসার ব্যবস্থাও করে দেওয়া হয়। সর্বস্বরূপবাবু জানিয়েছেন, বর্তমানে বলরামপুরের মহিলারা এ ব্যাপারে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করেছেন এবং তাঁরা নিজেরাই পাখিদের দেখভাল করতে পারেন।
চাহিদা বৃদ্ধিই ব্যবসায় এনেছে মুনাফা -
সাহু জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে টার্কির চাহিদা ক্রমবর্ধমান। বিশেষ করে উৎসবের মরসুমে রেস্তোরাঁ মালিকরা চাইছেন স্পেশাল ডিস হিসেবে টার্কি রাখতে। এছাড়াও টার্কি বর্তমানে স্বাস্থ্যসচেতন মানুষেরও বেশ প্রিয়। রেড মিটের থেকে অনেক কম চর্বিযুক্ত মাংস হয় টার্কির। সাহু জানিয়েছেন ২০১৯ সালে কেবল সরকারের ঘর থেকেই টার্কির মাংস বিক্রি হয়েছিল ১০ টন। ২০২০ সালে তা দ্বিগুণ হওয়ার লক্ষ্যে। কলকাতার ফুড ব্লগার এবং ইউটিউবার ইন্দ্রজিৎ লাহিড়ি জানিয়েছেন, মানুষ বর্তমানে ট্র্যাডিশনাল বা ওরিয়েন্টাল ডিশের বদলে কন্টিনেন্টাল ডিশ পছন্দ করতে শুরু করেছেন। আর কন্টিনেন্টাল ডিশে টার্কি রীতিমতো জনপ্রিয়। তাই টার্কিচাষের অভ্যাসটা বাড়াতে হবে, তাহলে আরও লাভের মুখ দেখবে বলে আশা ইন্দ্রজিতের।
ত্রয়ী মুখার্জী
Image source - Google
Related Link - (Turkey rearing) টার্কি পালন আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যম
Share your comments