অত্যধিক চাহিদা ও ভাল বাজারদর (৩০০-৩৫০ টাকা কেজি) থাকায় এই ফলের চাষ খুবই লাভজনক। চাষিদের মধ্যে জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম কারন প্রাথমিক খরচ একটু বেশি হলেও এই গাছটি থেকে ২০-২৫ বছর ফল পাওয়া যায়। এই ফল এখন চাষ হচ্ছে পশ্চিম বাংলার বেশ কিছু জায়গায়। খাদ্যগুণেও অতুলনীয় এই ফল। চাহিদাও বাড়ছে উত্তরোত্তর। খাদ্যগুণের কারণে এই ফলকে ‘রাজা’ বলে অভিহিত করছেন বিশেষজ্ঞরা।
লতানো ক্যাকটাসের মতন ড্রাগনের গাছে ফল আসে মে মাসে, ফলন হয় নভেম্বর মাস পর্যন্ত । বছরে ৬-৭ বার ফল পাওয়া যায়। ফুল ফোটা থেকে ফল পাকা পর্যন্ত ২৮-৩০ দিন সময় লাগে। পর্যাপ্ত রোদ, জল, জৈব সার এবং নিয়মিত পরিচর্যায় আসে বাহারী ফুল, তারপর সেই ফুল থেকে ধরে লোভনীয় রঙের ড্রাগন ফল। গাছ বসানোর ১৮ মাসের মধ্যে ফুল ধরে। সেই ফুল থেকে একমাসের মধ্যে ছোট ছোট ফল হয়। ফল পাড়ার দশ-বারো দিন পরেও তাজা থাকে।
জলবায়ু ও মাটিঃ
উষ্ণ-আদ্র আবহাওয়াতে মোটামুটি খুব অম্ল বা ক্ষার মাটি ছাড়া সব মাটিতেই অল্প পরিচর্যায় এই ফলটি চাষ করা যায়। তবে উপযুক্ত জল নিকাশির ব্যবস্থা রাখতে হবে।
বংশবিস্তার ও চারা তৈরিঃ
পশ্চিমবঙ্গের কিছু জেলায় এই ফল চাষে চাষিরা বিশেষ মনোযোগী হয়েছে। গুজরাট রাজ্যে প্রথম এই ড্রাগন ফল চাষ সফল হয়। অনেক নার্সারি তেই এখন ড্রাগন ফলের চারা তৈরি হচ্ছে। বীজ থেকে চারা তৈরি করা যায়। কিন্তু সফলতার হার খুব কম হওয়ায় কাটিং থেকে চারা করা ভাল। এছাড়া বীজ থেকে তৈরি চারায় মাতৃ গাছের সমস্ত গুন থাকে না।পশ্চিমবঙ্গের আবহাওয়ায় কাটিং এর চারা থেকে প্রায় ১৪-১৫ মাসের মধ্যে ফল ধরতে শুরু করে। কিন্তু বীজ থেকে তৈরি চারায় ফল ধরতে তিন বছর সময় লাগে। ৫০-৭০ সেমি দীর্ঘ কাটিং নিতে হবে এবং পর্যাপ্ত পরিমান জল দিতে হবে ভাল শিকড় পেতে। সুষম পরিবেশ পেলে কাটিং এর চারা তৈরির সফলতার হার ৯০% । সুস্থ-সবল, ভাল ফলন যুক্ত এবং রোগমুক্ত গাছ থেকে ডাল সংগ্রহ করতে হবে। ডাল কাটার পর ছত্রাকনাশক যেমন কারবেনডাজিম বা ম্যানকোজেব প্রতি লিটার জলে ২-৩ গ্রাম মিশিয়ে ডালের কাটা অংশে ২-৫ মিনিট ভিজিয়ে রেখে ১০-১৫ মিনিট শুকিয়ে নিতে হবে।
চারা তৈরির পলিব্যাগঃ
৬-৮ ইঞ্চি মাপের পলিব্যাগে দোআঁশ মাটি ও জৈব সার (১:১ অনুপাত) মিশ্রন ভরতে হবে। এরপর প্রস্তুত কাটিং পলিব্যাগের মাটিতে ১.৫-২ ইঞ্চি গভীরে পুঁতে দিয়ে ভালভাবে মাটি চাপা দিতে হবে।প্রায় সারা বছর ধরে চারা করা গেলেও নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস উপযুক্ত সময়।
জমি তৈরি ও চারা রোপণঃ
উপযুক্ত ভাবে চাষ দিয়ে মাটি সমান করতে হবে। চারা রোপণের ১০-১৫ দিন আগে ২-২.৫ মিটার অন্তর গর্ত তৈরি করতে হবে। প্রতিটি গর্তের পরিমাপ-৭৫ সেমি দীর্ঘ, ৭৫ সেমি প্রস্থ ও ৭৫ সেমি উচ্চতাযুক্ত। প্রতি গর্তে ২৫ কেজি জৈব সার, ৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ৩০০ গ্রাম সিংগল সুপার ফসফেট, ৩০০ গ্রাম মিউরিয়েট অব পটাশ মাটির সাথে মিশিয়ে গর্ত ভর্তি করতে হবে।
ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে চারা লাগিয়ে ফেলতে হবে। সিমেন্টের খুঁটির চারপাশে ৩-৪ টি চারা রোপণ করতে হবে।পিলারের উচ্চতা ৪.৫-৫ ফুট।
পিলারের মাথায় জিআই পাইপের লোহার রিং, সাইকেলের চাকার রিং বা টায়ার লাগানো হয়। গাছগুলি মাটি থেকে পাঁচ ফুট উচ্চতায় খুঁটি দিয়ে উপরে উঠে রিংয়ের চারপাশে ফোয়ারার মত ঝুলতে থাকে।
সার প্রয়োগ ও সেচ ব্যবস্থা (Fertilizer & irrigation) -
ভাল ফসল পাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত পরিমান সার প্রয়োগ করতে হবে। নাইট্রোজেনঃ ফসফরাসঃ পটাশ ৪৫০:৩৫০:৩০০ কিলোগ্রাম প্রতি হেক্টর।
ড্রাগন ফল চাষে তেমন সেচ লাগে না। তবে মাটির রসের অবস্থা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সেচ দিতে হবে। উপযুক্ত জল নিকাশির ব্যবস্থা রাখতে হবে।
সাথী ফসলঃ
এই বাগানে পেঁয়াজ, রসুন, ফুলকপি, বাঁধাকপিও বসানো যায়। একই মাটি ও সারে এক সঙ্গে ৩-৪টি ফসলের চাষ করা যাবে।
ফসলঃ
প্রায় ১৪-১৫ মাসের মধ্যে ফল ধরতে শুরু করে। তিন বছর পর গাছগুলি গড়ে ১৫ থেকে ২০ কেজি ফল দিতে পারে। আর ৫ বছর পর ফল ধারণ ক্ষমতা বেড়ে হয় ৪০ থেকে ৫০ কেজি।
রোগ-পোকা (Disease & pest management) -
এই গাছে রোগ-পোকার উপদ্রব কম। পিঁপড়ের আক্রমন দেখা যায়। পাখিরা ফুল ও পাকা ফলের ক্ষতি করে।
কাণ্ড ও গোড়া পচা রোগঃ
ছত্রাক অথবা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা এই রোগ হতে পারে। এই রোগ হলে গাছের কাণ্ডে প্রথমে হলুদ রং এবং পরে কাল রঙ ধারন করে। পরবর্তীতে ঐ অংশে পচন শুরু হয় এবং পচার পরিমান বাড়তে থাকে।
এই রোগ দমনের জন্য প্রতি লিটার জলে যেকোনো ছত্রাকনাশক(কারবেনডাজিম, ব্যাভিস্তিন, থিওভিট) ২ গ্রাম ভাল ভাবে স্প্রে করতে হবে।
পোকা-মাকড়ঃ
পোকা-মাকড় খুব একটা চোখে পড়ে না, তবে মাঝে মাঝে জাব পোকা ও দয়ে পোকার আক্রমন করে থাকে। বাচ্চা ও পুরন বয়স্ক পোকা গাছের কচি শাখা ও পাতার রস চুষে খায়। ফলে আক্রান্ত গাছের কচি শাখা ও ডগার রং ফ্যাকাসে হয়ে যায় ও গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। গাছের বৃদ্ধি ও ফলন কমে যায়। এই পোকা ডগার উপর আঠালো রসের মত মল ত্যাগ করে। ফলে শুটি মোলড নামক কালো ছত্রাক রোগের সৃষ্টি হয়। এতে গাছের খাদ্য তৈরিতে ব্যহত হয়। ফলে ফুল ও ফল ধারন কমে যায়।
এই পোকা দমনের জন্য যে কোনও কীটনাশক যেমন সুমিথিওন বা ম্যালাথিওন ২ মিলি প্রতি লিটার জলে গুলে ভালভাবে গুলে প্রয়োগ করতে হবে।
নিবন্ধ - তনুশ্রী সাহা ও ডঃ সার্থক ভট্টাচার্য্য
Image source - Google
Related link - (Papaya Farming) পেঁপের বাণিজ্যিক চাষ করে কৃষক করতে পারেন অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন
(Kharif onion crop care) বর্ষাকালীন পেঁয়াজের পরিচর্যা ও শস্য সুরক্ষা
Share your comments