জারবেরা ফুলটির চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর চাষ করে কৃষকরা অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করতে পারেন। পলি হাউসে জারবেরা উদ্ভিদ চাষের জন্য তা প্রস্তুত করে অতি সহজেই রোপণ করা যায়। জৈব পদার্থের সংমিশ্রণে জারবেরা ফুলের উদ্ভিদগুলি উচ্চ মানের হয় এবং তা দ্রুত বৃদ্ধি লাভ করে। এতে ফুলের মানও বৃদ্ধি পায়।
পলিহাউসের (Poly house flower cultivation) অধীনে জন্মানো জারবেরিয়ার বিভিন্ন ধরণের বর্ণ-ভিত্তিক জাতসমূহ: (sub heading)শুভ্র বর্ণ : ব্যালেন্স, ডোনা টেলা, হলুদ বর্ণ : প্যারাডিসো, ব্রিলেন্স, ড্যানা ইলেন, ফ্রেডিকিং, নাদ্জা, ইউরেনাস, কমলা বর্ণ : গ্যালিয়্যাথ, মেরুন ক্লিমেন্টাইন, গোলাপী বর্ণ : রোজালিন, প্রি ইনটেনজ্, পিঙ্ক এলিগ্যান্স, ফ্লেমিংগো, ফ্রিডেইসি, টেরাকুইন, ভ্যালেন্টাইন, ইন্টেন্স, ব্রিক রেড বর্ণ : ওয়ালহালা এবং রক্তিম বর্ণ : জাফানা, স্ট্র্যানজা, ডাস্টি, ফ্রেডোরেলা, ভেস্তা, সাভানা, দ্বি-বর্ণ: শিমার ইত্যাদি।
প্রয়োজনীয় মৃত্তিকা –
জারবেরা চাষের জন্য প্রয়োজন বেলে দোআঁশ মৃত্তিকা। মাটিতে জৈব পদার্থ (কোকো-পিট / এফওয়াইএম / ভার্মি-কম্পোস্ট) ৭০ : ৩০ অনুপাতে মিশিয়ে ভালভাবে প্রস্তুত করতে হবে। উদ্ভিদটির সুচারু রূপে বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত ছিদ্রযুক্ত আদ্র মৃত্তিকার প্রয়োজন হয়। উদ্ভিদটির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য, সিঙ্গল সুপার ফসফেট ২০০ গ্রাম + নিম কেক ২০০ গ্রাম + হিউমিক অ্যাসিড ২০ গ্রাম + বায়োজাইম ৩০ গ্রাম + ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ৩০ গ্রাম + জিঙ্ক সালফেট ১৫ গ্রাম মিশিয়ে প্রতি বর্গ মিটারে প্রয়োগ করতে হবে। যখন উদ্ভিদটির ক্রমবর্ধমানতার জন্য দোআঁশ মাটি বা কাদা মাটি ব্যবহৃত হয়, তখন মাটিতে উন্নত বায়ু উত্তোলনের জন্য ১০-১৫ % বালি মিশ্রিত করতে হবে।মিশ্রণের পরে সঠিকভাবে বেড প্রস্তুত করতে হবে। বেডের উচ্চতা দৈর্ঘ্যে (৪৫ সেমি), প্রস্থে (উপরের পৃষ্ঠ: ৬০ সেমি এবং নিম্ন পৃষ্ঠ: ৬৭ সেমি) এবং মাঝের দূরত্ব (৩০সেমি) – এভাবে প্রস্তুত করা উচিত, তবে বেডের দৈর্ঘ্য গ্রীণ হাউস ঘরের আকৃতির উপর নির্ভর করে। বেড প্রস্তুত করার পর, কোন রকমের পোকামাকড় বা রোগের সংক্রমণ এড়াতে ফর্মালিন (১০০ মিলি / লিটার) জল-এর সাথে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। বেড ভালো ভাবে আদ্র করে (প্রতি বর্গমিটার অঞ্চল) প্লাস্টিকের কভার দিয়ে ৭ দিন পর্যন্ত ঢেকে রাখতে হবে। তারপরে বেডে (১০০ লি./ প্রতি বর্গমি.) পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জল দিতে হবে এবং রোপণের জন্য দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। এই সময়ে উদ্ভিদটির বৃদ্ধির জন্যে কার্বোফিউরন (ফিউরাডন ৫ গ্রাম / বর্গমিটার) প্রয়োগ করতে হবে। মূলযুক্ত টিস্যু কালচার উদ্ভিদগুলি বর্ষার ঠিক আগে বা পরে রোপণ করতে হবে। রোপণের সময় উদ্ভিদগুলির একটি থেকে অপরটির দূরত্ব যথাক্রমে ৩০*৩০ সেমি. এবং একটি সারি থেকে অপর সারির দূরত্ব বজায় রাখতে হবে ৩৭.৫*৩৭.৫ সেমি. এবং সেচ ব্যবস্থা অনুসরণ করতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে যে, রোপণের সময় যেন উদ্ভিদের উপরিভাগ মাটি স্তর থেকে ১ সেমি. উপরে থাকে। উদ্ভিদগুলি খুব হালকাভাবে বেডে স্থাপন করতে হবে। রোপণের পরে প্রতিদিন সকালে হালকা সেচ সরবরাহ করতে হবে এবং উদ্ভিদটির নিষ্কাশন এড়ানোর জন্য ৪-৬ সপ্তাহ পর্যন্ত ৮০-৯০% আর্দ্রতা বজায় রাখতে হবে। এটি অনুমান করা হয় যে, পলি হাউসে ১০০০ বর্গ মিটার এলাকায় প্রায় ৬০০০ টি গাছ রাখা যেতে পারে।
প্রয়োজনীয় ক্ষেত :
জারবেরা চাষের জন্য একটি সুসজ্জিত পলি হাউস ব্যবহার করা হয়, যেখানে সমস্ত যন্ত্র যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অধীনে স্থাপন করা হয় এবং উদ্ভিদের প্রয়োজনের ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রিত হয়। এই জাতীয় পলি হাউসের জন্য ড্রিপ এবং স্প্রিংকলার সেচ ব্যবস্থা থাকে, উচ্চ ফলনের জন্য ফার্টিগেশন এবং পিপিসি প্রয়োগ করতে হবে। এগুলি ছাড়াও আলো, তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ফ্যান, ফগারস, গারনেটস, শেড নেট, পোকার প্রুফ নেট সহ প্রাকৃতিক বায়ুচলাচল করতে পারে ইত্যাদির মতো অন্যান্য সুবিধাগুলিও এতে যুক্ত রয়েছে। কার্যকারিতা বৃদ্ধি এবং সহজেই সমস্ত প্রযুক্তি পদ্ধতি সঠিকভাবে কাজ করার জন্য, সকল যন্ত্রপাতি মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের পরে নিয়মিত চেক করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি বিষয়।জলবায়ু : এই গাছটি খুবই সংবেদনশীল। জারবেরা চাষের জন্য হালকা তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতার প্রয়োজন হয়। উদ্ভিদটি বেডে রোপণ করার সময় দিনের বেলায় ২২-২৫ ডিগ্রী এবং রাতে ১৮-২০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার প্রয়োজন। তবে এরপর উদ্ভিদটির বৃদ্ধি থেকে শুরু করে পরিণত স্তর অর্থাৎ ফুল পর্যন্ত সময়কালে যথাক্রমে দিনে ২০-২৫ ডিগ্রী এবং রাতের বেলায় ১২-১৬ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। শীতের মরসুমে খোলা আবহাওয়ায় এটি ভালভাবে বৃদ্ধি পায়, তবে অন্য মরশুমে বিশেষত গ্রীষ্মে এটির যত্ন নেওয়া উচিত। তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড -এর উপরে এবং ১২ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড- এর নীচে হলে, এই পরিস্থিতিতে উদ্ভিদটির জীবন ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। পার্শ্ব বায়ুচলাচলের ব্যবস্থা দিনের মধ্যে সকাল ৬ টা থেকে বিকেল ৬ টা পর্যন্ত খোলা রাখতে হবে এবং বাকি সময় বন্ধ রাখতে হবে। অর্থাৎ যখন বাইরের তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড -এর নীচে নেমে যায়, তখন পার্শ্ব বায়ুচলাচল বন্ধ করা উচিত, একইভাবে বাইরের তাপমাত্রা যখন ৩৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড -এর উপরে পৌঁছায়, তখন ফগার্স, ফ্যান এবং গারনেট প্রভৃতির প্রযুক্তিগুলি সকাল দশটা থেকে দুপুর দু’টা পর্যন্ত কার্যক্ষম পর্যায়ে রাখতে হবে।
আরও পড়ুন - জানুন ঢেঁড়সের পোকা- মাকড় ও রোগ-বালাই দমনের ব্যবস্থাপনা
দিনে ৮০-৮৫ শতাংশ আপেক্ষিক আর্দ্রতা উদ্ভিদটির বৃদ্ধির জন্য উপকারী। গ্রীষ্মের সময় অধিক তীব্রতা হ্রাস করার উদ্দেশ্যে পলিহাউসের অভ্যন্তরে অতিরিক্ত শেড (৩০-৩৫ % সবুজ শেড নেট) সরবরাহ করতে হবে। গ্রীষ্মের মাসগুলিতে, সকালের দিকে একদিন অন্তর হাতে করে বেডে জল দিতে হবে, এর ফলে উদ্ভিদের সতেজতা দীর্ঘক্ষণ বজায় থাকবে এবং পোকামাকড়ের সংখ্যাও হ্রাস পাবে। এছাড়া এই প্রক্রিয়ার ফলে পলিহাউসে উদ্ভিদগুলি গোড়া শুকিয়ে যাওয়া ও পচা থেকে রক্ষিত হবে।
তথ্যসূত্র – ড. তাপস কুমার চৌধুরী
আরও পড়ুন - জানুন টিউলিপ ফুলের বৈশিষ্ট্য ও টিউলিপ ফুলের চাষাবাদের পদ্ধতি
Share your comments