আপনার কাছে কি ৪-৫ বিঘা জমি রয়েছে? তাহলে এই জমিতে লেবুর চাষ করে আপনি অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করতেই পারেন। যে সব কৃষকের কাছে ১০-১৫ বিঘা জমি রয়েছে চাষের জন্য, তারা বেশি ফসলের জন্য স্মার্ট চাষে ভরসা করতে পারেন৷ লেবু চাষ খুবই লাভজনক। আর এই সময়ে চার থেকে পাঁচ বিঘা জমিতে লেবুর চাষ করে প্রায় ৭ লক্ষ টাকা উপার্জন করতে পারেন কৃষক।
কৃষকদের জন্য রইল লেবুর লাভজনক চাষাবাদ (Profitable Lemon Cultivation) -
উপযুক্ত মৃত্তিকা (Soil) -
পাতিলেবু নিজেকে বিভিন্ন ধরনের মাটির সাথে মানিয়ে নিতে সক্ষম। তবে, এই ফলটি কৃষ্ণ এবং হালকা দোআঁশ মাটিতে খুব ভালোভাবে চাষ করা যায়। হালকা দোআঁশ মাটি অর্থাৎ যেখানে মাটির কণার বিন্যাস সমান, উত্তম নিকাশি ব্যবস্থা সম্পন্ন, এবং জৈব পদার্থের প্রাচুর্য এমন মাটি পাতি লেবু চাষের পক্ষে আদর্শ। মাটিতে দীর্ঘদিন জলমগ্ন দশা এই ফল চাষের পক্ষে খুব ক্ষতিকারক। গাছের গোড়ায় কোনভাবেই যেন জল না জমে তা সুনিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে জলের ঘাটতি এবং মাটিতে আর্দ্রতার পরিমাণ কমে গেলেও তা গাছের উৎপাদনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। উত্তম উৎপাদনের জন্য মাটির পিএইচ (pH) ৬.৫-৭.৫ এর মধ্যে থাকা উচিত। মাটির মধ্যে ক্ষারীয় পদার্থ এবং চুনের (লাইম) পরিমাণ বেশি থাকলে তা গাছের সুষম বৃদ্ধিতে বাধার সৃষ্টি করে। কারণ তা মাটিতে মাইক্রো-নিউট্রিয়েন্ট এর সরবরাহ কমিয়ে দেয়।
চারা তৈরি -
চারা তৈরির জন্য প্রথমে বীজগুলি কে উপযুক্ত ছত্রাক-নাশক দ্বারা শোধন করে নিয়ে বপন করা দরকার। না হলে অঙ্কুরোদগমের পর চারা গুলির ‘ডাম্পিং অফ (Damping Off)’ অথবা 'ঢলে পড়া রোগের' প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। এরপর বীজগুলিকে ১৫ সেন্টিমিটার × ২.৫ সেন্টিমিটার দূরত্ব বরাবর, পূর্বে প্রস্তুত করা বেডের মধ্যে রোপণ করা হয়। নার্সারি বেড তৈরির জন্য জুন-জুলাই অথবা নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ভালো করে কোদালের সাহায্যে মাটি খুড়ে, তার সাথে খুব ভালো গোবর-সার এবং বালি যুক্ত দোআঁশ মাটি মিশিয়ে উঁচু একটি বেড তৈরি করা হয়। বেড খুব ভালো করে তৈরি হয়ে গেলে ঝাঁজরির সাহায্যে ১% বোর্দো মিশ্রণ অথবা ব্লাইটক্স এর দ্রবণ তৈরি করে প্রতিটি বেড খুব ভালো করে ভিজিয়ে দিতে হবে। বীজগুলি লাগানো সম্পূর্ণ হয়ে গেলে নিয়মিত ঝাঁজরির সাহায্যে জল দিতে থাকতে হবে, যেন নার্সারি বেডে কখনোই আর্দ্রতার অভাব না ঘটে।
চারা লাগানোর সময়ঃ
প্রতিবছর ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি মাস এবং জুন-সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে পাতি লেবু গাছের চারা লাগানো যায়।
চারা লাগানোর পদ্ধতিঃ (Plantation method) -
পাতিলেবুর চারা ৪-৬ মিটার দূরত্বে মূল জমিতে লাগানো যেতে পারে। মধ্য ভারতের মাঝারি ধরনের মাটিতে পাতিলেবু ৫.৫-৬ মিটার দূরত্বে লাগানো হয় এবং অগভীর মাটিতে ৪-৪.৫ মিটার দূরত্বে লাগানো হয়ে থাকে। দেখা গিয়েছে উত্তরভারতের গাঙ্গেয় সমভূমিতে দুটি গাছের মধ্যে আদর্শ দূরত্ব ৬.৫ মিটার। খুব কম দূরত্বে (High density orchard) গাছ লাগাতে চাইলে ৩ × ৩ মিটার দূরত্ব অবলম্বন করে চারা লাগানো যেতে পারে, কিন্তু, ৮-১০ বছর পর মাঝখান থেকে একটি করে গাছের সারি কেটে সাফ করে দিয়ে বাকি গাছের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা এবং আলোর ব্যবস্থা করতে হবে।
চারা লাগানোর জন্যে গর্ত খোঁড়া এবং ভর্তি করার পদ্ধতিঃ -
চারা লাগানোর আদর্শ সময় হল জুন থেকে ডিসেম্বর মাস। চারা লাগানোর পূর্বে জমিতে ৭৫ × ৭৫ × ৭৫ সেন্টিমিটার গর্ত খুঁড়তে হবে। সাধারণত দুই-তিন সপ্তাহ আগে গর্ত করে তৈরি করে রাখা হয়। গর্ত খোঁড়ার পর অন্তত ১৫-২০ দিন ওই গর্ত গুলোকে উন্মুক্ত ফেলে রাখা হয়। এরপর চারাগুলিকে ৫-৬ মিটার দূরত্বে এই গর্তগুলোতে বসাতে হবে।
জৈব এবং রাসায়নিক সারের ব্যবহারঃ (Fertilizer application)
কোন গাছে কতটা সার দিতে হবে সেটা সাধারণত জমির প্রকৃতি, মাটির উর্বরতা শক্তি, এলাকা এবং কোন ধরনের জাত ব্যাবহার করা হয়েছে তার উপর নির্ভর করে। গাছের প্রয়োজনীয় সার সব সময় জৈব এবং অজৈব সারের মাধ্যমে প্রয়োগ করা উচিত। জৈবসার প্রয়োগ করলে লেবুজাতীয় ফলের ক্ষেত্রে অনেক ধরনের সুবিধা পাওয়া যায় বিশেষ করে। জমির উপরে সবসময় জৈবসার প্রয়োগ করলে মাটির গঠন এবং ভৌত প্রকৃতি খুবই ভালো থাকে।
সমস্ত গাছের সম্পূর্ণ নাইট্রোজেনের চাহিদা গোবর সার (২৫%), তেল-খৈল (২৫%) এবং রাসায়নিক সারের (৫০%) পূরণ করতে হবে। ফসফরাস (P) এবং পটাশিয়াম (K) যথাক্রমে সুপার ফসফেট এবং সালফেট অফ পটাশ অথবা মিউরিএট অফ পটাশ এর মাধ্যমে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
একটি পূর্ণবয়স্ক পাতিলেবু গাছে বছরে ৫০ কেজি গোবর সার, ৯০০ গ্রাম নাইট্রোজেন, ২৫০ গ্রাম ফসফেট এবং ৫০০ গ্রাম পটাশ অবশ্যই দিতে হবে। পুরো পরিমাণ গোবর সার এবং ফসফেট, অর্ধেক পরিমাণ নাইট্রোজেন এবং পটাশ বর্ষার প্রয়োগ করা হয়। বাকি অর্ধেক নাইট্রোজেন এবং পটাশ গাছে ফুল আসার পর অর্থাৎ মার্চ-এপ্রিল মাসে প্রয়োগ করা হয়।
আমাদের দেশে পাতিলেবু তে সাধারণত গাছের গোড়ায় গোলাকার রিং বানিয়ে তারমধ্যে সার প্রয়োগ করা হয়। পাতি লেবুর গাছের শিকড় মাটির ভেতরে খুব বেশি গভীরে বিস্তৃত হয় না বেশিরভাগ শেখ মাটির উপরিভাগ থেকে ৪৫-৬০ সেন্টিমিটার এর মধ্যেই অবস্থান করে।
বছরে তিনবার (মার্চ, জুলাই এবং অক্টোবর মাসে) গাছের কচি পাতা বেরোনোর সময় ০.৫% হারে (৫০০ গ্রাম/ ১০০ লিটার জলে গুলে) জিংক সালফেট কাছে গাছে স্প্রে করা অত্যন্ত জরুরি।
জলসেচ ব্যবস্থাঃ
পাতিলেবু গাছে গ্রীষ্মকালে ৫-৭ দিন অন্তর সেচ দিতে হবে, তবে শীতকালে ১০-১৫ দিন অন্তর সেচ যথেষ্ট। তবে, কখন গাছে জল দিতে হবে সেটা নির্ধারণ করার পূর্বে মাটির মধ্যে আর্দ্রতার পরিমাণ যাচাই করে নেওয়া উচিত। যদি মাটির উপরিভাগ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার গভীর পর্যন্ত মাটিতে কোন আর্দ্রতা না থাকে সেক্ষেত্রে তৎক্ষণাৎ জলসেচের ব্যবস্থা করা উচিত।
আগাছা দমন (Weed management) -
গাছের গোড়ায় আগাছা দমন খুবই প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। সাধারণত লেবু গাছে লেবু বাগানে আগাছা দমন করার জন্য Monouron, Diuron এবং Gramoxone নামক আগাছানাশক ব্যবহার করা হয়। Diuron প্রতি ৫০০ লিটার জলের মধ্যে ২-৩ কেজি হারে মিশিয়ে গাছের গোড়া থেকে অন্তত ৩০-৪০ সেন্টিমিটার দূর থেকে স্প্রে করতে হবে। এই আগাছানাশক প্রয়োগ করলে এটি প্রায় ১০ সপ্তাহের জন্য আগাছা কে নিয়ন্ত্রণ করে রাখে। আগাছা বেরিয়ে যাবার পর তার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য Gramoxone + Diuron -এর মিশ্রণ ব্যবহার করা হয়। এই মিশ্রণটি দ্বিবীজপত্রী আগাছা নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশ কার্যকর। ৩ কেজি Diuron -এর সাথে ১.৫ কেজি Gramoxone -এর মিশ্রণ প্রতি তিনমাস অন্তর প্রয়োগ করলে তা পাতিলেবু গাছের বাগানে খুব সাফল্যের সাথে আগাছা নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়াও আগাছা বেরিয়ে যাবার পর হেক্টর প্রতি ২ কেজি গ্লাইফোসেট (Glyphosate) ব্যবহার সব থেকে বেশি কার্যকরী।
আরও পড়ুন - সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে কলম পদ্ধতিতে গোলাপ চাষ (Cultivation Of Roses)
Share your comments