"নৌকার পাটাতনে যে কাঠ ব্যবহৃত হয় তা কেবলমাত্র পাটের!"শিবরাম চক্রবর্তীর কিছু অদ্ভুদ কান্ডকারখানা

আজ আমরা কথা বলব এক চক্কতি মসাইকে নিয়ে।মানে শিবরাম চক্রবর্তীকে নিয়ে । যদিও কৃষির সঙ্গে শিবরাম চক্রবর্তির কোন সম্পর্ক নেই।

Saikat Majumder
Saikat Majumder
শিবরাম চক্রবর্তী

আজ আমরা কথা বলব এক চক্কতি মসাইকে নিয়ে।মানে শিবরাম চক্রবর্তীকে নিয়ে । যদিও কৃষির সঙ্গে শিবরাম চক্রবর্তির কোন সম্পর্ক নেই। তবে কি জানেন তো,ভালোবাসার মানুষকে আমরা সব জায়গাতেই খুঁজে পাই।তাই কৃষির সাথেও জরিয়ে নিলাম শিবরাম চক্রর্বতীকে ।কিভাবে কৃষির সঙ্গে  তাঁকে জরিয়ে নিলাম সেই গল্পটা আপনাদের পরে বলব।তার আগে এই খেয়ালী এবং রসিক মানুষটির কিছু অদ্ভুদ কান্ডকারখানা আপনাদের শোনাই।

শিবরাম ছিলেন চাঁচলের রাজবাড়ির উত্তরসূরী। যদিও পৈত্রিক সম্পত্তিতে তেমন কোন আগ্রহ তাঁর ছিল না ।শিবরাম চক্রবর্তীর আর্থিক কষ্ট দেখে একবার তাঁর বন্ধুরা তাকে বলল,না ভায়া এবার তোমাকে একটা মামলা করতেই হবে। বন্ধুদের জোরাজুরিতে সম্পত্তির দাবী নিয়ে  মামলা ঠুকলেন আদালতে । এবং মামলা হল রীতিমতো শিবরামীয় কায়দায়। নিজের পক্ষে কোনো উকিল নেই। তিনি নিজেই উকিল। আছেন কেবল একজন সাক্ষী। আর সাক্ষী অন্য কেউ নন যার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেছেন, স্বয়ং তিনিই সাক্ষী। তাঁর বিশ্বাস, সাক্ষী মিথ্যা বলবেন না। কিন্তু যথারীতি সাক্ষী নিজের পক্ষেই বলল এবং মামলার নিষ্পত্তি সেখানেই। এরকম আরো অসংখ্য খেয়ালীপনায় গড়া তার জীবন।আর তার এই খামখেয়ালীপনা বার বার মুগ্ধ করেছে আমাদের।

একবার শিবরামের এক ভক্ত তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি লেখেন কখন, শিবরাম চক্রবর্তী তাকে বলেন, সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে পড়ি,তখন বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে নি। তারপর হাতমুখ ধুয়ে চা-জলখাবার খেয়ে আবার শুয়ে পড়ি। দুপুরবেলা খাওয়া দাওয়ার পর তো ভাতঘুম বাঙালির ন্যায্য পাওনা। তাই দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে একটা ভাতঘুম দিয়ে নি। বিকেলে চা জলখাবার খেয়ে ভাবি কোথায়ই বা যাব তার চেয়ে, ‘বরং শুয়েই থাকি’। রাতের বেলার খাওয়া সেরে আবার ঘুমিয়ে পড়ি। প্রশ্নকর্তা তখন বিস্মিত হয়ে জানতে চান, “তাহলে লেখেন কখন!”নির্বিকার ভঙ্গিতে শিবরাম উত্তর দেন, “কেন, পরের দিন!”

এরকম আরও অসংখ্য ঘটনা শিবরামবাবুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। সেগুলো শোনাবো আপনাদের। তার আগে কৃষির সঙ্গে শিবরামবাবুর সম্পর্ক কিভাবে সেটা আপনাদের বলি,শিবরাম চক্রবর্তীকে কিছুদিনের জন্য এক কৃষি পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব সামলাতে হয়েছিল, না না সত্যি সত্যি নয়, গল্পে,লিখেছিলেন আমার সম্পাদক শিকার , ব্যস এতটুকুই ছিল কৃষির সাথে তাঁর সম্পর্ক। বাংলাদেশের সমস্ত নামী কাগজে নিজের লেখা পাঠিয়ে যখন একখানা কাগজেও লেখা প্রকাশিত হল না, তখন তিনি বেশ মর্মাহত হলেন।মাসিক থেকে পাক্ষিক–পাক্ষিক থেকে সাপ্তাহিকে নামতে হল; অগত্যা লেখাটার দারুণ অমর্যাদা ঘটছে জেনেও দৈনিক সংবাদপত্রেই প্রকাশের জন্য পাঠালেন।কিন্তু সেখান থেকেও ফেরত এল। দৈনিকে নাকি অত বড় সংবাদ ধরবার জায়গাই নেই। আশ্চর্য! এত আজেবাজে বিজ্ঞাপন যা কেউ পড়ে না তার জন্য জায়গা আছে, তাঁর বেলাই যত স্থানাভাব? বিজ্ঞাপন বাদ দিয়ে ছাপলেই তো হয়।

আরও পড়ুনঃ ঐতিহ্যের বোঝা নিজেদের কাঁধে নিয়ে আজও ছুটে চলেছে হাতে টানা রিকশা

এইভাবে বাংলা মুলুকের তাবৎ কাগজ থেকে লেখা ফেরৎ আসার পর বাকি রইল কেবল একখানি কাগজ, কৃষি সম্বন্ধীয় সাপ্তাহিক পত্রিকা।তাঁর কথায়, চাষাড়ে কাগজ বলেই ওর দিকে তেমন কোন মনোযোগ দিইনি, তারা কি আমার এই সাহিত্য রচনার মূল্য বুঝবে? ফেরত তো দেবেই, হয়তো সঙ্গে সঙ্গে বলে পাঠাবে, মশাই আপনার আষাড়ে গল্প আমাদের কাগজে অচল; তার চেয়ে ফুলকপির চাষ সম্বন্ধে যদি আপনার কোনো বক্তব্য থাকে তা লিখে পাঠালে বরং আমরা দেখতে পারি।

সম্পাদক লেখা পড়ে শিবরামবাবুকে জিজ্ঞাস করলেন, তা আপনি কি এর আগে আর কখনও লিখেছেন?

ঈষৎ গর্বের সঙ্গেই তিনি জবাব দিলেন–নাঃ, এই আমার প্রথম চেষ্টা।

তা প্রথম লেখা তো সম্পাদকের যথারিতি পছন্দ হয়নি। কিন্তু তাকে দামায় কার সাদ্ধি। তিনি যে শিবরাম চক্রবর্তী।

গ্রামের বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতা এসেছিলেন কিশোর শিবরাম। কোথায় থাকবেন, কী করে পেট চালাবেন জানা নেই। পেট চালাতে খবরের কাগজও বিক্রি করতে হয়েছে তাকে । তিনি লিখতেনও পেটের দায়ে।তিনি বলতেন,গায়ে জোর নেই বলে রিক্সা টানতে পারি না।তার বদলে এই কলম টানি। কলমের উপর টান আমার অতটুকুই।

তাঁর দ্বিতীয় লেখাটি সম্পাদকের দারুন পছন্দ হল। এতই পছন্দ হল যে সম্পাদক খুঁশি হয়ে একদম সম্পাদকের চেয়ার টা তাকে দিয়ে বললেন, আমি তিন মাসের ছুটি নিয়ে ঘাটশিলায় হাওয়া বদলে যাচ্ছি, আপনি যদি সেই সময়ে আমার কাগজটা চালাতেন।

শিবরামবাবু তো দারুন খুঁশি,একেই বলে সম্পাদক শিকার করতে এসে সম্পাদকতা শিকার।

কলম বাগিয়ে -কৃষিতত্ত্বের- সম্পাদকীয় লিখতে শুরু করলেন। যদিও সম্পাদকীয় লেখার জন্য ঘুণাক্ষরেও কোন অনুরোধ ছিল না সম্পাদকের, কিন্তু ওটা বাদ দিলে সম্পাদকতা করার কোন মানেই হয় না, এতএব তিনি লিখলেন।

আমাদের দেশে ভদ্রলোকের মধ্যে কৃষি সম্বন্ধে দারুণ অজ্ঞতা দেখা যায়। এমন কি, অনেকের এরকম ধারণা আছে যে এই সব তক্তা আমরা দেখি, দরজা, জানালা কড়ি, বরগা, পেনসিল তক্তপোষে যেসব কাঠ সাধারণতঃ দেখতে পাওয়া যায় সে সমস্ত ধান গাছের। এটা অতীব শোচনীয়। তারা শুনলে অবাক হয়ে যাবেন যে ওগুলো ধান তো নয়ই, বরঞ্চ পাট বলা যেতে পারে। অবশ্য পাট গাছ ছাড়াও কাঠ জন্মায়; আম, জাম, কাঁঠাল, কদবেল ইত্যাদি বৃক্ষেরাও তক্তাদান করে থাকে। কিন্তু নৌকার পাটাতনে যে কাঠ ব্যবহৃত হয় তা কেবলমাত্র পাটের।…

তার সাহিত্যের হাস্যরস ছিল সম্পূর্ণ স্বভাবজাত। কোথাও জোর করে হাসানোর এতটুকু প্রবণতা ছিল না, পাঠক নিজ মনেই পড়তে পড়তে হাসির রাজ্যে হারিয়ে যান। একটি শব্দের পিঠে আরেকটি শব্দ চালিয়ে, ইংরেজিতে যেটিকে আমরা ‘PUN’ বলে থাকি, বাংলা সাহিত্যে এটির প্রবর্তন করেছিলেন শিবরাম চক্রবর্তী।

খাদ্যরসিক ছিলেন,খেতে খুব ভালোবাসতেন,আর সে খাবার যদি হয় সন্দেশ কিংবা রাবরি তাহলে তো কোন কথাই নেই।একবার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে রবীন্দ্রমঞ্চে শিবরাম চক্রবর্তীর সংবর্ধনার ব্যবস্থা হয়েছে।পাশে বসে রয়েছেন স্বপনবোড়ো মানে শিশু সাহিত্যেক অখিল নিয়োগী।তিনিও বক্তা। মঞ্চে মানপত্র পাঠ হল। পাশে বসা স্বপনবুড়োকে  শিবরামবাবু বললেন , এসব মানপত্র দিয়ে আমার কি হবে ,ঘরের দেয়ালে টানানোর জায়গা নেই। তার চেয়ে বরং একটু রাবরি আনলে কাজে দেয়। বেজায় খিদে পেয়েছে।শেষ পর্যন্ত রাবরি এল । সংবর্ধনার মঞ্চে বসেই খাওয়া শুরু করলেন তিনি। 

আরও পড়ুনঃ সত্যিকারের কৃষক বন্ধু হয়ত ভার্গিস কুরিয়েনই ছিলেন

খুদে পাঠকরাই ছিল তাঁর বন্ধু। বেজায় ভালবাসতেন ছোটদের। জীবনে কোনও দিন কারও নিন্দা করেননি, শুনতেও চাইতেন না।

কেউ যদি কখনও এসে বলতেন, শিবরামদা আপনার নামে অমুকে খারাপ কথা বলে বেড়াচ্ছেন, সঙ্গে সঙ্গে শিবরামের উত্তর, ‘‘হতেই পারে না। আপনিই ভুল শুনেছেন।’’ বলেই তার হাত ধরে নিয়ে যেতেন খাওয়াতে। নিজেকে সাহিত্যিক পরিচয় দিতেও সংকোচ। বলতেন, ‘‘ধুর ধুর আমি আবার সাহিত্যিক হলাম কবে? প্রেমেন, অচিন্ত্য, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভুষণ এরা হলেন সাহিত্যিক। কত ভাল ভাল লেখেন!!’’

নিজের সম্পর্কে বলতেন,আমি কখনই কালজয়ী হতে চাইনি,সেই বৃথা চেষ্টার কালক্ষয় না করে সকলের জীবনের সকালটা,না জয় করতে নয়,তার সঙ্গী হতেই চেয়েছিলাম আমি।ছেলেমেয়েরা ছোটবেলায় আমার লেখা পরবে,একটু বড় হলেই অক্লেশে ভুলে যাবে আমায়।সেই একটুক্ষানি হাসি-হাসি করতে পারলেই আমার খুঁসি।

১৯২৯ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মানুষ’ প্রকাশিত হয়। একই বছরে প্রকাশিত হয় আরেকটি কাব্যগ্রন্থ- ‘চুম্বন’। লিখেছেন ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ এবং ‘হাতির সাথে হাতাহাতি’-এর মতো অসাধারণ কিছু উপন্যাস। ‘ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসা’ নামের স্মৃতিকথা গ্রন্থে তিনি লিখে গেছেন নিজের কথা। সৃষ্টি করেছেন হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন, বিনি, ইতুর মতো স্মরণীয় কিছু চরিত্র।

এই খেয়ালী লোকটার শেষকাল কেটেছিল নিদারুণ কষ্টে। নিজেই নিজের অবস্থা নিয়ে বলতেন,

“জিনিসপত্র সব বাঁধা হয়ে গেছে। এবার একটা ট্যাক্সি পেলেই চলে যাব।”

হঠাৎ একদিন প্রবল জ্বরে দুর্বল হয়ে বাথরুমেই সংজ্ঞা হারান তিনি। সারারাত পড়ে ছিলেন সেখানেই। পরদিন জানাজানি হলে তাকে ভর্তি করানো হয় হাসপাতালে। সেদিন ছিল ২৮ আগস্ট, ১৯৮০। এক পর্যায়ে ডাক্তার তাকে জিজ্ঞেস করেন,

“শিবরামবাবু, এখন কেমন লাগছে শরীর?”

জড়ানো গলায় উত্তর দেন,

“ফার্স্টক্লাস।”

তার কয়েকমিনিট পরেই মৃত্যু হয় শিবরাম চক্রবর্তীর।এক অজানা রাজ্যে হারিয়ে যান হাসির রাজা শিবরাম।তবে তার সাহিত্যকর্ম আজও ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের মাঝেই।

Published On: 03 January 2023, 03:56 PM English Summary: The wood used for the deck of the boat is only jute! Some of the strange works of Shivram Chakraborty

Like this article?

Hey! I am Saikat Majumder. Did you liked this article and have suggestions to improve this article? Mail me your suggestions and feedback.

Share your comments

আমাদের নিউজলেটার অপশনটি সাবস্ক্রাইব করুন আর আপনার আগ্রহের বিষয়গুলি বেছে নিন। আমরা আপনার পছন্দ অনুসারে খবর এবং সর্বশেষ আপডেটগুলি প্রেরণ করব।

Subscribe Newsletters