কীটনাশক ও বাস্তুচিন্তা

বর্তমান কৃষিতে ফসলের ক্ষতিকারক কীট বা পেস্ট এবং আগাছা কৃষকদের কাছে এক প্রধান সমস্যা। কীটনাশকের ব্যবহার একজন উৎপাদকের কাছে অত্যন্ত জরুরী একটি উপাদান। কিন্তু কয়েকটি বিষয় খুব সহজেই চিন্তা করতে বাধ্য করে তার মধ্যে একটি হল, কীটনাশক আমাদের এবং আমাদের বাস্তু জগতের পক্ষে কতখানি ক্ষতিকারক।

KJ Staff
KJ Staff

আধুনিক কৃষিতে খাদ্য উৎপাদনে কীটনাশক একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান। খাদ্য সংরক্ষণ, বীজ সংরক্ষণ, উৎপাদনের সঠিক পরিমাণ বজায় রাখবার জন্য সারা বিশ্বে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহৃত হয়। শুধুমাত্র ফসলের ক্ষতিকারক পেস্ট বা কীটদের নিয়ন্ত্রণ তথা দমন করবার জন্য বিশ্বের প্রতিটি দেশে রাসায়নিক উপাদান সম্বন্বিত কীটনাশকের ব্যবহার হয়ে চলেছে বিগত ষাট সত্তর দশক ধরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির একটি সহজ সমীকরণ হয়ে উঠেছে এই কীটনাশক, যা বর্তমানে মানব স্বাস্থ্যের সাথে সাথে পারিপার্শ্বিক জীবজগতের অস্তিস্ব রক্ষার জন্য অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং ফ্যাক্টর হিসেবে পরিগণিত হতে চলেছে।

বর্তমান কৃষিতে ফসলের ক্ষতিকারক কীট বা পেস্ট এবং আগাছা কৃষকদের কাছে এক প্রধান সমস্যা। শুধু কৃষকদেরই নয়, যারাই কৃষিক্ষেত্রে বিশাল আকারের উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়েছে, তারাই এই ধরণের একটি ভয়ংকর সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে বারংবার, তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই কীটনাশকের ব্যবহার একজন উৎপাদকের কাছে অত্যন্ত জরুরী একটি উপাদান। কিন্তু কয়েকটি বিষয় আপনাদেরকে খুব সহজেই চিন্তা করতে বাধ্য করবে যে, সত্যিই কীটনাশক আমাদের কাছে এবং আমাদের বাস্তু জগতের পক্ষে কতখানি ক্ষতিকারক।

  • আমেরিকা মহাদেশে সারা বৎসর শুধুমাত্র কৃষিক্ষেত্রে এক বিলিয়ন পাউন্ড কীটনাশক ব্যবহার হয়, এর অর্থ দাঁড়ায় আমেরিকার প্রতিটি নাগরিক গড়ে তিন পাউন্ডের থেকে বেশী পরিমাণে কীটনাশক প্রতি বৎসর খাদ্যের সাথে গ্রহণ করে চলেছে।
  • শিশুদের ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় কীটনাশক বিষ অনেক বেশি ক্ষতিকারক, এর প্রধান কারণ হামা দেওয়া শিশুরা সবথেকে বেশী সময় মাটির কাছাকাছি থাকে এবং তাদের একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হল মাটিতে কিছু পড়ে থাকলে তা মুখে তুলে নেওয়া। এছাড়াও শিশুদের স্বাস্থ্য অনেক বেশী কমনীয়, তাই কীটনাশক বিষ শিশুদের শরীরতন্ত্রের স্থায়ী ক্ষতিসাধন করতে পারে।
  • কীটনাশকের অধিকতর ব্যবহার মৌমাছি ও অন্যান্য উপকারী পতঙ্গদের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। বর্তমানে এই মারণ বিষ ক্ষতিকারক কীটেদের সাথে সাথে উপকারি কীটদেরও ক্ষতিসাধন করে, তাই মৌমাছিদের মতো পরাগযোগে সাহায্যকারী জীবেদের সংখ্যা ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। কীটনাশকের বহুমুখী ব্যবহারই এর জন্য দায়ী। ইউনাইটেড স্টেটসের এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি (EPA) কতগুলি কীটনাশক রাসায়নিককে চিহ্নিত করেছে যেগুলি মধুমক্ষীদের ক্ষেত্রে মারাত্মক বিষ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। গবেষণায় এও দেখা গেছে কোনো একটি মৌমাছি দূষিত রেণু গ্রহণ করে মৌচাকে আসে তাহলে সমগ্র মৌচাকটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
  • সবসময় তরকারি বা ফলমূল ধুয়ে খাওয়া সম্ভব হয় না, যদিও বা ঠিকঠাক ধোওয়া হয় তাতেও একশ শতাংশ কীটনাশককে দূর করা সম্ভব নয়। কিছু পরিমাণ তারপরেও ফলমূল ও তরকারির গায়ে লেগে থাকে, কোনো কোনো কীটনাশক তো সবজি ও ফলের মধ্যে মজ্জাগত হয়ে যায়, কীটনাশকের মধ্যে নিহিত বিষাক্ত রাসায়নিক ফসলের কলাতন্ত্রে দুকে পড়ে এবং এদের বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়তে থাকে। কিছু ফল ও সবজি, যেমন- আপেল, স্ট্রবেরী, আঙ্গুর, পীচ, পালং, ক্যাপ্সিকাম, শসা, চেরী টমাটো ইত্যাদিতে পেস্টিসাইডের প্রভাব মারাত্মক, তাই এইসব ফল ও সবজিগুলিকে যতখানি সম্ভব জৈব উপায়ে সৃষ্টি করাই ভালো।
  • পেস্টিসাইডের রাসায়নিক উপাদান মানব স্বাস্থ্যের উপর বিশেষ করে মানব শরীরতন্ত্রের মধ্যে বাসা বাঁধতে পারে যা কিনা সেই নির্দিষ্ট অঙ্গ বা তন্ত্রের উপর স্থায়ী ক্ষতিসাধনে সক্ষম। জৈব কীটনাশকের উপাদানগুলি জৈব ভঙ্গুর তাই কোনো ক্ষতি সাধিত হয় না, কিন্তু রাসায়নিক উপাদানগুলি আমাদের জৈব তন্ত্র দ্বারা বিনষ্ট হয় না, এগুলি আমাদের চর্বি কলার মধ্যে নিহিত হয়ে থাকে এবং বিনষ্ট হতে কয়েক মাস বা কয়েক বছর আবার কখনও বা কয়েক দশক সময় লেগে যায়।
  • ডি ডি টি ( ডাইক্লোরো ডাইফিনাইল ট্রাইক্লোরো ইথেন) একটি মারাত্মক হানিকারক অজৈব পলিমার, এই রাসায়নিকটির উপর আমেরিকান সরকার ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে নিষেধাজ্ঞা জারী করেছিল। গবেষণায় দেখা গেছে ডি ডি টি আমাদের লিভার ও নার্ভ তন্ত্রের ক্ষতিসাধন করে, ডি ডি টি-এর একটি অণুকে ভাঙতে মানব জৈব তন্ত্রের ১৫ থেকে ১৭ বৎসর সময় লাগে। এই অজৈব পদার্থ আমাদের ফ্যাটযুক্ত কোশে অঙ্গীভূত হয়ে যায় এবং আমেরিকার বহু মানুষ এর বিষাক্ত রাসায়নিকের স্থায়ী প্রভাব ভোগ করে চলেছে। লিভার সিরোসিস নামক ভয়ানক মারন ব্যাধির শিকার হয়েছে বহু মানুষ। এখনো বহু মানুষ এই ভয়ংকর পদার্থটিকে বহন করে চলেছে নিজের শরীরের মধ্যে।
  • মৃত্যু পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে পৃথিবীতে সারা বৎসর প্রায় ১৮,০০০ চাষির মৃত্যু ঘটে শুধুমাত্র কীটনাশক ছড়ানোর জন্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুসারে সারা পৃথিবীতে ৩০ লক্ষেরও বেশি মানুষ তাঁদের উৎপাদনের ক্ষেত্রে কীটনাশক ব্যবহার করে থাকে তাঁদের মধ্যে ১৮,০০০ হাজারেরও বেশী মানুষের মৃত্যু ঘটে শুধুমাত্র কীটনাশকের প্রভাব-এর ফলে।
  • আমেরিকান এনভায়রনমেন্ট প্রোডাকশন এজেন্সির গবেষণার ফলস্বরূপ জানা গেছে পৃথিবীতে যেখানে যেমন পরিমাণ পেস্টিসাইড ব্যবহার করছে তার দশ শতাংশ হয় বৃষ্টির জলের সাথে মিশে ভৌমজলের স্তরে মিশে যাচ্ছে, বা শুকনো বাতাসের সাথে মিশে উড়ে যাচ্ছে। একটি পরিসংখ্যাগত হিসাব বলছে সারা পৃথিবীতে ৭০ মিলিয়ন পাউন্ড কীটনাশক এইভাবে নষ্ট হয়ে যায়।
  • খাদ্যশৃংখলে কীটনাশকের প্রভাব মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। যদি কোনো ইঁদুর কোনো পোকাকে খায়, এবং পোকাটির শরীরতন্ত্রে যদি কোনো কীটনাশকের প্রভাব থাকে তবে তার কিছুটা অংশ পরবর্তী খাদক অর্থাৎ ইঁদুরের শরীরে বাহিত হবে, আবার সেই ইঁদুরটিকে যদি চিল বা বাজ খেয়ে থাকে তবে তার শরীরেও এই কীটনাশকের কিছুটা পরিবাহিত হবে। ১৯৫০-১৯৬০-এই সময়কালের মধ্যে চিল বা বাজের বহু প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। চিল, বাজ বা শকুনের এই ভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার ঘটনাকেই র‍্যাচেল কারসন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “দি সাইলেন্ট স্প্রিং”-এ লিপিবদ্ধ করেছেন, যা পরবর্তীকালে মানুষকে কীটনাশকের ভয়ংকর প্রভাব প্রত্যক্ষ করতে শিখিয়েছে।
  • কীটনাশকের বহুব্যবহার সম্বন্ধে আমরা কতটুকুই বা জানি। যখন সরকারি তরফের থেকে যে কোনো নির্দিষ্ট কয়েকটি কীটনাশকের রাসায়নিক উপাদান নিয়ে গবেষণা চলছে, সেখানে বিবিধ কীটনাশক যৌগ মিলেমিশে কী ধরণের যৌগের রূপ ধারণ করছে এবং তা আমাদের শরীরে কী ধরণের প্রভাব বিস্তার করছে তা জানা এখনও আমাদের কাছে সাধ্যের অতীত।

বিভিন্ন সরকারি ও স্বাস্থ্য সংস্থার নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও আজও অনেক ক্ষতিকারক রাসায়নিক উপাদান দিয়ে কীটনাশক উৎপাদন কার্য জারী আছে। অনেক সংস্থা মানুষের বা বাস্তুতন্ত্রের পারিপার্শ্বিক পরিবেশে কীটনাশকের ক্ষতিকারক প্রভাবের কথা বিবেচনা না করেই শুধুমাত্র নিজেদের আখের গোছাতেই কীটনাশক নামক বিষাক্ত রাসায়নিক বস্তুর উৎপাদন করে চলেছে। ভারতীয় কৃষি পরিবেশ যতটা না কীটনাশক উৎপাদনের জন্য দূষিত হয়েছে, তার থেকে বেশি দূষিত হয়েছে, তার থেকে বেশী দূষিত হয়েছে কৃষকদের অবৈজ্ঞানিক ও অনিয়ন্ত্রিত কীটনাশক প্রয়োগের কারণে, এই ব্যবস্থার উন্নতির আশু প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। রাসায়নিক কীটনাশকের বদলে ফল ও সবজি চাষে জৈব পরিবেশ বান্ধব কীট নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিগুলির ব্যবহার কৃষকদের জানা উচিৎ এবং সবসময়ের জন্য সরকারি তরফ থেকে সাধারণ মানুষদের এই বিষয়ে ওয়াকিবহাল করার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কৃষি আমাদের ভিত্তি তখনই হয়ে উঠবে যখন কৃষির সাথে সামাজিক চিন্তাধারাকে গুরুত্বের সাথে বিচার করা হবে।

লেখক : প্রদীপ পাল 

রুনা নাথ(runa@krishijagran.com)

Published On: 03 July 2019, 01:23 PM English Summary: effect-of-use-of-excessive-pesticide

Like this article?

Hey! I am KJ Staff. Did you liked this article and have suggestions to improve this article? Mail me your suggestions and feedback.

Share your comments

আমাদের নিউজলেটার অপশনটি সাবস্ক্রাইব করুন আর আপনার আগ্রহের বিষয়গুলি বেছে নিন। আমরা আপনার পছন্দ অনুসারে খবর এবং সর্বশেষ আপডেটগুলি প্রেরণ করব।

Subscribe Newsletters