সুন্দরবনের নামের ইতিহাস যাই থাক না কেন, তার সৌন্দর্য এখন আমফানে বিপন্ন, আরো কতবার চিরসবুজকে, সুন্দরবনকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে – তা জানা নেই। প্রকৃতির রুদ্ররোষের মধ্যে দিয়ে বারবার তার আত্মশুদ্ধির ও অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার মরণপণ পরীক্ষা চলবেই। নদীবাঁধ দিয়ে লবণাক্ত জলকে আটকে শস্যশ্যামলা মোহনার পলিতে সমৃদ্ধ উর্বরতা কবে ফিরে পাবে, আমাদের প্রিয় সবুজ মোহন সুন্দরবন – সেটা এখন চিন্তার বিষয়। যেখানে জলে খেলে বেড়াবে অগুনতি মাছ, সেই উজ্জ্বল উদ্ধার কীভাবে সফল হবে, যাতে আমাদের বাংলার জীববৈচিত্র্য ও প্রাচুর্যে ভরা প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের উত্তরাধিকার আমরা হারিয়ে ফেলবো না। আয়লার পর আমফান ঝড়ের গভীর প্রভাব সুন্দরবনের সর্বত্রই নিজরে পড়ছে, যেখানে প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষের মধ্যে ২০ লক্ষই অসুরক্ষিত এবং তাদের বেশীরভাগই প্রান্তিক চাষী। এই উৎসাহী প্রান্তিক পরিবারের আয় ও পুষ্টির সুনিশ্চিত নিরাপত্তা একান্ত প্রয়োজন। কত যে পুকুর বা জলাশয় ব্যবহারের রয়েছে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে ক্ষয়ক্ষতি পুনুরুদ্ধার করে মাছ চাষের মাধ্যমে এদের অধিকতর সক্ষম করে তোলা যায়, সে সম্পর্কে কিছু কথা এখানে বলা হল।
নতুন করে চাষ করতে চাইলে কি কি মাছ নেওয়া যেতে পারে – এই প্রসঙ্গে কয়েকটি মাছের নাম উল্লেখ করতে হলে বাটা, মুক্তোগাছা, উন্নত প্রজাতির তিলাপিয়া, দেশী মাগুর, সিঙ্গি, সিলভার কার্পের কথা প্রথমেই বলতে হয়। এই মাছগুলি অল্প সময়ে ও ব্যয়ে বিক্রয়ের উপযোগী হয়ে ওঠে। বিশেষ করে কোন পরিচর্যারও প্রয়োজন পড়ে না। এগুলি সবকটি সর্বভুক, এমনকি জৈব বর্জ্যও। তিন- চার মাসের মধ্যেই ১৫০ গ্রাম ওজনের হয়ে যেতে পারে আর অধিক ঘনত্বে টিকে রাখার ক্ষমতা রাখে, এমনকি জলে লবণাক্ততার সহনশীলতা লক্ষ করা যায় এদের।
সুন্দরবনের চাষী কোথা থেকে এই সব মাছের পোনা সংগ্রহ করবে?
সুন্দরবনের বেশীরভাগটাই দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার অন্তর্ভুক্ত আর এই জেলাতেই আছে দুটি কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র – একটি নিমপীঠে ও অপরটি আড়াপাঁচে (সোনারপুরের কাছে) আর কিছুটা অংশ পড়ে উত্তর ২৪ পরগণায় সেখানেও আছে আরেকটি কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র- অশোকনগরে অবস্থিত। এছাড়াও অনুরূপ প্রত্যেক ব্লকে আছে মৎস্য সম্প্রসারণ আধিকারিক ও মৎস্য সহায়ক আধিকারিক। এত নিষ্ঠাবান মৎস্য আধিকারিক ও বিশেষজ্ঞের দেখা আমি পেয়েছি- আমি নিশ্চিত যে কোন সময় এনাদের সহায়তা পাওয়া সম্ভব।
বিঘা প্রতি জলাশয়ে মোট ১০০ টি করে তো চারাপোনা ছাড়া যেতেই পারে – কিছু বেশী হলেও কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সোনারপুরে এক বিশেষজ্ঞ চাষী আছেন, সুকল্যাণ মন্ডল (ফোন – ৯৬৭৪৪১৫২৩৯, যাকে ফোন করে মাছের পোনা ছাড়াও হরেক প্রয়োজনে পাওয়া যায়)। মাছের পোনা ছাড়ার আগে শুধু নিশ্চিত করে নেওয়া দরকার যে, পুকুরের জল ঠিক আছে কি না। এই সাইক্লোনের পড়ে অনেক পুকুরের জলই খুব ভালো অবস্থায় নেই।
জল পরীক্ষা ও পরিচর্যা -
সাধারণ লট পেপারের (যা নিকটবর্তী কোন ওষুধের দোকানে পাওয়া যেতে পারে, কুড়ি- পঁচিশ টাকায়) সাহায্যে জলের pH দেখে নেওয়া দরকার – কারণ কিছু পুকুরে প্রয়োজনীয় পিএইচ ৭.৫ নেই। যদি পুকুরে পিএইচ-এর পরিমাণ কম থাকে, তবে তা চুন প্রয়োগ করে (বিঘা প্রতি ২০ কিলোর বেশী নয়, বাড়িয়ে নেওয়া যায়। দু একটি ক্ষেত্রে পি এইচ এত বেশী যে, তাকে নামিয়ে আনার প্রয়োজন পড়ে। এর জন্য তেঁতুল বা আমড়া গাছের ডালপালা পুকুরে ফেলে দুদিন রেখে দেখা যেতে পারে পি এইচ কমলো কি না - নচেৎ প্রয়োজনে কিছু তেঁতুল কাপড়ে বেঁধে লাঠির ডগায় ঝুলিয়ে রাখলেই কাজ হবে।
তবে খুব সকালের দিকে বা আবহাওয়া যদি মেঘলা থাকে, তখন জরুরী অবস্থার ভিত্তিতে পুকুরের জলে অক্সিজেন সরবরাহের জন্য পার্শ্ববর্তী চিত্রে প্রদর্শিত যন্ত্রটি ব্যবহার করা যেতে পারে। যদি পুকুরে পানা ভর্তি থাকে, তবে খড়ের দড়ি বানিয়ে টানা দিয়ে পুকুরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে আনা যায় ও তা সহজেই তুলে ফেলা সম্ভব, যাতে মাছ চাষে অসুবিধার না সৃষ্টি হয়- জলে সূর্যালোক ঠিকমতো পড়তে পারে। এখন জলের তাপমাত্রা মাছের বাড় বৃদ্ধির পক্ষে খুব অনুকূল, তাই কালবিলম্ব না করে চারাপোনা মজুত করা দরকার। মাছ ছাড়ার সময় একটু সইয়ে নিয়ে ছাড়তে পারলে পোনাগুলি সব বেঁচে যায়।
জলে হাঁড়ি ডোবানোর ছবিটি দেখলে একটু আন্দাজ পাওয়া যাবে। এরপর ১৫ দিন অন্তর দিনে একবার করে জৈবজুস (যা তৈরী হবে ৫০০ গ্রাম গুঁড়ো বাদাম খোল, সেদ্ধ করা চালের খুদ ৫০০ গ্রাম, সঙ্গে ১০০ গ্রাম চিটে গুড়, এক চিমটে খাবার লবণ দিয়ে মাটির কলসিতে ১০ লিটার জল দিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখতে হবে তিনদিন – কেবল রোজ একবার করে ছোট দণ্ডের সাহায্যে মিশিয়ে বা ঘেঁটে দিলে ভালো হয়) প্রয়োগ করতে হবে। তরলটি (জৈবজুস) বানিয়ে বাতিল করা ১০ টি জলের বোতলে ভরে, ছিপিতে ছিদ্র করে তা ঝুলিয়ে দিতে হবে পুকুরে নির্দিষ্ট ব্যবধানে – তা বাঁশের সাহায্যে হোক বা অন্য কোনভাবে হোক। এতে প্রাকৃতিক খাদ্যকণা তৈরী হবে সহজে। এবার এই খাদ্যকণা আরও ভালোভাবে জন্মাতে পারে যদি কম্পোষ্ট করা গোবর পুকুরের বিভিন্ন জায়গায় চেরা বাঁশের মধ্য দিয়ে প্রয়োগ করা যায়। মাঝে মাঝে আখের ছিবড়ে কঞ্চিতে জড়িয়ে পুকুরে পুঁতে দিতে পারলেও প্রাকৃতিক খাদ্যকণা পর্যাপ্ত জন্মাতে পারে ও চাষী প্রায় নিখরচায় মাছে বাড় পেয়ে যেতে পারেন। যদি মাসে একবার জাল টানা যায়, তাহলে মাছের বাড় বৃদ্ধি সম্পর্কে ধারণাটা ভালো হতে পারে সেই মতো খাবার দিতে হবে কি না, তার সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। যদি তা দিতেই হয়, তবে চিঁড়ের গুঁড়ো/গোটা ধানের গুঁড়োর সঙ্গে সরষের খোল ও কিঞ্চিত মেথি গুঁড়ো মিশিয়ে গরম জলের সাহায্যে বল তৈরী করে (ছবিতে যেমন দেখানো হয়েছে, অনুরূপভাবে) প্রয়োগ করা যেতে পারে।
অল্প পুঁজিতে এটি সম্ভব, এই সময়ে ব্যয়সাপেক্ষ কোন পদ্ধতির প্রয়োগে চাষীর অসুবিধা থাকতে পারে। মাছের ফলন থেকে আয় হলে পরবর্তী পর্যায়ে, তিনি আরও ভালোভাবে চাষের কথা চিন্তা করতে পারবেন। যার পক্ষে সম্ভব, তিনি পুকুর পাড়ে হাঁসের ঘর বানাতে পারেন। কয়েকটা হাঁস পুকুরে চড়ে বেড়ালে মাছের বাড় ভালো হয়, বাড়তি আয়ও হয়।
সুন্দরবন থেকে সেরা মাছ সারা বছর পাওয়া সম্ভব। মাছ ও চিংড়ি চাষের মাধ্যমে জীবন পূর্ণতা পাক ও সেই সাথে মানও বাড়ুক জীবিকার। সুন্দরবনে সাইক্লোন প্রবণ অবস্থা হয়তো থাকবে- এর ভৌগোলিক অবস্থার কারণে, কিন্তু মাছ ও কৃষির উন্নয়নের সুযোগ এখানে অফুরন্ত, এদিকে নজর দিলে সর্বতোভাবেই সাফল্য আসবে।
নিবন্ধ - ড. প্রতাপ কুমার মুখোপাধ্যায় (অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিজ্ঞানী, আইসিএআর, সিফা, ভুবনেশ্বর) এবং প্রধান অধ্যাপক, মৎস্য বিভাগ, নেওটিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ডায়মন্ডহারবার (বর্তমান ভারপ্রাপ্ত)
Image Source - Google
Related Image - (Profitable fish Tilapia farming) তিলাপিয়া মাছের প্রজনন ও ব্রুডস্টক পরিচর্চা
মেষপালন (Sheep Farming) করে আজ লক্ষাধিক মুনাফা অর্জন করছেন এই কৃষক
(White sandalwood) শ্বেত চন্দন চাষ করে কৃষক উপার্জন করতে পারেন ৬০ লাখ থেকে ১ কোটি পর্যন্ত
Share your comments