গাঁদা চাষ (Marigold Flower Cultivation) আমাদের রাজ্যের অনেক জায়গাতেই বাণিজ্যিকভাবে হয়ে থাকে। এই ফুলের চাষ পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার মোশরা গ্রামের আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে জোরদার করছে এবং সেখানকার বেকার গ্রামবাসী, বিশেষত নারীদের ক্ষমতায়ন করছে।
সুদূর আমেরিকার এই ফুল আমদের রাজ্যে দুই মেদিনীপুর, হাওড়া, হুগলী, উত্তর ২৪ পরগণা সমেত বর্ধমান, মুর্শিদাবাদের কিছু অঞ্চলে আর সবথেকে ব্যাপক আকারে নদীয়ার রাণাঘাট, কালিনারায়ণপুর, চাপড়া, বঙ্কিমনগরে বেদীপুর ইত্যাদি জায়গায় বাণিজ্যিক চাষ চালু হয়।
বাণিজ্যিকভাবে খোলা মাঠে চাষের ক্ষেত্রে নানা ফুলের মধ্যে প্রথমেই অল্প পুঁজিতে আর চাহিদায় সেরা সারা বছরের ফুলবাজার ধরতে গাঁদা অতুলনীয়। গৃহসজ্জা ও টবের ফুলেও সহজ চাষে এই ফুল একেবারে এক নম্বরে। ফুলের মালা, অনুষ্ঠান বাড়ি সাজানোতে, তোড়া, খুচরো ফুল হিসাবে পূজায়, বাড়ির বাগানে টবের অপরূপ শোভার পাশাপাশি বর্তমানে ভেষজ আবির তৈরিতে এর ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়েছে। আর গাঁদার ঔষধগুণের (Marigold Flower Medicinal Properties) মধ্যে এর ফুল- পাতার রস কাটা স্থানে জলদি রক্ত বন্ধের কার্যকারিতা আমরা অনেকেই জানি।
সময়ভেদে গাঁদার দুভাবে বংশবিস্তার / চারা তৈরি করা হয় –
(১) বীজের মাধ্যমে,
(২) কাটিং থেকে।
১) বীজের থেকে চারা তৈরি :
শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে চারা বসানোর ক্ষেত্রে মার্চ মাস (ফাল্গুন – চৈত্রে) ফুল ভালোভাবে শুকিয়ে বীজ সংগ্রহ করে বা কেনা বীজে সবজির মতোই বীজতলায় চারা তৈরি করতে হয়। গরমের সময় গাছগুলি বাড়লেও ফুল না নিয়ে কাটিং এর জন্য ব্যবহার হয়। আবার চৈত্র থেকে আষাঢ়ে ফুল পাবার জন্য পৌষমাসে বীজ থেকে চারা তৈরি হয়। হাইব্রিড টবের বা সজ্জার গাঁদার জন্য কার্ত্তিকের শেষ থেকে অঘ্রাণ মাসে বীজতলায় বীজ বুনে ছোট চারা করে ছোট্ট বাটির খুপরি / শিকড়ে মাটি লাগিয়ে বিক্রি করে ব্যবসায়িক নার্সারিরা ভাল লাভ করেন।
২) কাটিং থেকে চারা তৈরি :
আষাঢ় মাস থেকে কার্ত্তিক মাস অবধি ফুলচাষে কাটিং-এর চারাই জনপ্রিয় ও সুবিধাজনক। কাটিং-এর জন্য তৈরি ঝাঁকালো গাছের প্রতি ডগা ৩/৪ ইঞ্চি ধারালো ব্লেডে কেটে শিকড় বাড়ানোর হরমোন পাউডারের (অ্যারোডিক্স / রুটেক্স / সেরাডিক্স ইত্যাদি) ১ নম্বর / ‘A’ গ্রেড (নরম কাণ্ডের জন্য) কাটা অংশে লাগিয়ে মোটা ধোয়া বালির চালিটা বা স্থানে বসিয়ে দিলে দু সপ্তাহেই শিকড় বেরিয়ে ঐ চারা আর দিন ৭ / ১০ হাপায় রেখে বসানোর উপযুক্ত হয়।
পরবর্তী পরিচর্যা ও চাপান সার প্রয়োগ :
চারা লাগানোর মাস খানেক পরেই গাছে কুঁড়ি চলে আসলেও বাণিজ্যিক বেশী উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রথম ৩ / ৪ বার কুঁড়ি ও ডগা কেটে ফেলে দিলে ( ‘পিন্চিং’ করা ) গাছে ডালপালা ছেড়ে ঝাঁকালো হয়ে প্রচুর ফুল দীর্ঘদিন তোলার পরিস্থিতি তৈরি হয়। পিন্চিং চলার সঙ্গে মাসখানেক থেকে মাস দেড়েকে বিঘায় ২০ কেজি ১০ : ২৬ : ২৬ সুফলা দিয়ে নালা থেকে মাটি তুলে গোঁড়া ধরিয়ে দিলে চাপানের সঙ্গে বড় বৃদ্ধি দ্রুত হয়। বাড় – বৃদ্ধি ভালো না হলে জলে গোলা ১৮ : ১৮ : ১৮ সার ৫ গ্রাম / লি. জলে গুলে সপ্তাহ অন্তর ২ বার স্প্রে দিন। ফুল আসার পর ( চারা লাগানোর মাস দুয়েকে ) জলে গোলা ১৩ : ৪৫ সার ৪ গ্রাম / লি. জলে সপ্তাহ ব্যবধানে দুবার স্প্রে তে ভালো ফল পাওয়া যায়। গাঁদায় সেচ খুব ভাসিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। মরশুম ভেদে জমির জো দেখে ৭ – ১৫ দিন ব্যবধানে হালকা সেচ দেওয়া উচিৎ।
পোকা সমস্যার সমাধান :
১ ) মাকড় –
গাঁদার প্রধান শত্রু মাকড়। মাকড়ের আক্রমণ হয় বর্ষাকালে চারা, কচি ডগা, কুঁড়ি, ফুল সবেতেই। মাকড় গাঁদা গাছের রস চুষে নেয়, ফলে গাছের ফলন নষ্ট হয় এবং গাছটিও নষ্ট হয়ে যায়।
প্রতিকার :
প্রোপারজাইট ২ মিলি. বা স্পাইরোমেসিফেন ১/২ মিলি. / লি. জলে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
২ ) জাবপোকা –
গাঁদা গাছের কচি ডগা ও পাতার রস শোষণকারী পোকা। এটি গাছকে দুর্বল ও বিবর্ণ করে এবং গাছ নষ্ট করে দেয়।
প্রতিকার :
ইমিডাক্লোপ্রিড ১ মিলি. / ৩ লি. জলে মিশিয়ে নিয়মিত স্প্রে করতে হবে।
৩ ) থ্রিপস বা চোষী পোকা –
এরাও রস শোষণকারী পোকা আর প্রতিকার একইভাবে করতে হবে।
আরও পড়ুন - তুলসী চাষে আগাছা নিয়ন্ত্রণ এবং রোগ-পোকা ব্যবস্থাপনা (Pest Management In Tulsi Farming)
৪ ) ল্যাদা পোকা –
এই ধরণের পোকা গাঁদা গাছের কুঁড়ি ও কচি ডগা খেয়ে নষ্ট করে।
প্রতিকার :
প্রাথমিকভাবে যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এর দমন করতে হবে। বেশী পরিমাণে আক্রমণ হলে ডেল্টামেথ্রিন + ট্রায়াজোফস ২ মিলি / লি. স্প্রে করতে হবে।
তথ্যসূত্র - ড: শুভদীপ নাথ, সহ উদ্যানপালন আধিকারিক, উত্তর ২৪ পরগণা।
আরও পড়ুন - কাঠ গোলাপ বা ফ্রাংগিপানি ফুলের চাষ পদ্ধতি (Frangipani Flower Cultivation)
Share your comments