ভারতবাসীর খাদ্যতালিকায় এক অবিচ্ছেদ্য উপাদান হল পেঁয়াজ। প্রধানত মশলাপাতি ও সবজি হিসাবে এর ব্যবহার হয়। কন্দ ছাড়াও পেঁয়াজের পাতা ও কলি উপাদেয় খাদ্য। সরাসরি সবজি, সালাদ, মশলা, আচার তৈরীতে ব্যবহৃত হয়। উত্তরোত্তর এর বৈদেশিক এবং আভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ার জন্য চাষীবন্ধুদের এই চাষের আগ্রহ বাড়ছে। পশ্চিমবঙ্গের বৈচিত্র্যপূর্ণ জলবায়ু এবং মাটিতে এই চাষ এখন ক্রমশ বাড়ছে এবং রবি মরশুমের সাথে সাথে কিছু এলাকায় খারিফ মরশুমেও এর চাষ হচ্ছে।
উন্নত জাত এবং সঠিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে খারিফ মরশুমেও একক এলাকা থেকে অধিক ফলন এবং আয় করা সম্ভব।
মাটি ও জলবায়ু (Soil & Climate) –
উর্বর, জলনিকাশি ব্যবস্থাযুক্ত গভীর, ঝুরঝুরে, জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ বেলে দোআঁশ বা পলি মাটি পেঁয়াজ চাষের জন্য উপযুক্ত। অধিক অম্ল বা ক্ষার মাটিতে পেঁয়াজের আকার ছোট হয় ও পুষ্ট হতে বেশী সময় লাগে। জল জমে থাকে এমন মাটিতে এই চাষ ভালো হয় না। ১৩ – ২৪ C তাপমাত্রায় এই চাষ ভালো হয়।
জাত নির্বাচন – এগ্রিফাউন্ড ডার্করেড, ভীমা ডার্করেড, ভীমা রাজ, আরকা কল্যাণ, ফুলে সফেদ ইত্যাদি।
বীজের পরিমাণ – ৭-৮ কেজি প্রতি হেক্টরের জন্য থাইরাম, কার্বেন্ডাজিম বা ট্রাইকোডার্মা ২ গ্রাম/কেজি বীজ শোধনের জন্য ব্যবহার করা হয়।
বীজতলা তৈরী –
-
জুন-জুলাই মাসে খারিফ পেঁয়াজের বীজতলা তৈরী করা হয়।
-
প্রায় ১ মিটার চওড়া ও ৩-৪ মিটার লম্বা মাপের ২০-২৫ সেন্টিমিটার উঁচু বীজতলা আদর্শ। দুই বীজতলার মাঝে ৭ সেমি ব্যবধান রেখে দিলে বীজতলায় মাধ্যমিক পরিচর্যার সুবিধা হয়।
-
বীজতলা স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে ৭-১০ দিন ঢেকে রাখলে আগাছা কম হবে এবং বিভিন্ন রোগের আক্রমণও অনেক কম হবে।
-
ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি মিশ্রিত জৈব সার বীজতলায় প্রয়োগ করুন।
-
বীজতলার মাটিতে কেঁচো সার, পাতা পচা সার, গোবর সার মিশিয়ে বীজতলাতে বীজ বপন করা হয়।
-
বেলে দোআঁশ মাটি ঝুরঝুরে করে ৪-৫ সেমি. দূরে দূরে সারি করে বীজ বপন করা হয়।
-
বীজ বপনের পর ঝুরো কম্পোস্ট সার দিয়ে ভালো করে ঢেকে ঝাঁঝরি দিয়ে হালকা সেচ দিতে হবে।
-
পুরো বীজতলা খড় দিয়ে ঢেকে দিলে মাটির সঠিক আর্দ্রতা বজায় থাকবে।
-
অঙ্কুরোদগমের ঠিক পরেই খড়ের আচ্ছাদন তুলে দিতে হবে।
-
রোগ-পোকা দেখা মাত্র স্প্রে করতে হবে।
-
৬-৭ সপ্তাহের চারা মূল জমিতে রোপণ করতে হবে।
জমি তৈরী এবং সার প্রয়োগ –
-
চারা রোপণের পূর্বে এমনি সবজির মতো মাটি ভালোভাবে চাষ করে ঝুরঝুরে, আগাছা ও নুড়িকাঁকড় মুক্ত করে নিতে হবে।
-
মাটি পরীক্ষার ভিত্তিতে পরিমাণ মতো জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি হেক্টরে ২০-২৫ টন জৈব সার, এনপিকে – ১২০:৬০:৬০ কেজি/হেক্টর এবং সালফার ৩০ কেজি/হেক্টর দরকার ভালো ফলনের জন্য।
-
জমি তৈরীর সময় পুরো ফসফেট, পটাশ, সালফার এবং ১/২ কেজি ইউরিয়া বা N এবং বাকি ১/২ N দুইবার চাপান হিসেবে ৩০ দিন ও ৪৫-৫০ দিন রোপণের পর প্রয়োগ করতে হবে।
-
ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি কালচার ১৫০০ গ্রাম ঝুরঝুরে কেঁচো সারের সাথে মিশিয়ে আলাদাভাবে মুলো জমিতে প্রয়োগ করুন।
-
খারিফ মরশুমে বেড তৈরী করে চারা রোপণ করা হয়। ১.৮ এম চওড়া এবং লম্বা (জমির অবস্থা অনুযায়ী) দুটি বেডের মাঝে ১ ফুট ব্যবধান রাখা হয়। জলসেচ, জল নিষ্কাশন নালা, মাধ্যমিক পরিচর্যা ইত্যাদির সুবিধা হয়।
-
৬-৭ সপ্তাহের চারা কার্বেন্ডাজিমে শিকড় চুবিয়ে শোধন করা হয়।
-
এক সারি থেকে অপর সারির দূরত্ব ১৫ সেমি. এবং এক চারা থেকে অপর চারার দূরত্ব রাখতে হবে ১০ সেমি.।
অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা –
১) পেঁয়াজের শিকড় বেশী নীচে বিস্তার লাভ করে না আর চারা কাছাকাছি থাকার জন্য প্রথম থেকেই জমি আগাছা মুক্ত রাখতে হবে।
২) আগাছানাশক হিসাবে অক্সিফুরফেন ১ মিলি/লি. জলে মিশিয়ে রোপণের ৩ দিনের মধ্যে স্প্রে করতে হবে।
৩) হুইল হো বা হাত নিড়ান দিয়ে একবার আগাছা পরিষ্কার করলে ভালো।
৪) মাটির অবস্থা, ফসলের বাড়ন্ত এবং বৃষ্টিপাতের অবস্থা দেখে জমিতে সেচ দেওয়া হয়।
৫) চারা রোপণের পরেই একটা হালকা সেচ দরকার।
৬) বাল্ব তৈরীর সময় জমি শুকনো থাকলে হালকা সেচ দিতে হয়।
৭) চাপান সার প্রয়োগ করার পর সেচ দিতে হবে।
৮) এনপিকে (১৯:১৯:১৯) চারা রোপণের ১৫, ৩০ এবং ৪৫ দিন পর এবং মালটি K (১৩:০:৪৬) ৬০, ৭৫ এবং ৯০ দিন বাদে স্প্রে করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
ফসল তোলা এবং ফলন –
-
খারিফ মরশুমে গাছের পাতা নুইয়ে পড়ে না সেই রকমভাবে। পরিণত গাছে তাই পূর্ণ আকার এবং পরিপক্কতা দেখে ফসল চয়ন করা হয়।
-
দেরীতে ফসল তুললে রোগ আক্রমণের সম্ভবনা বেশী থাকে।
-
সঠিকভাবে বিজ্ঞান্সম্মত পদ্ধতিতে চাষ করলে হেক্টর প্রতি ২৫-৩০ টন ফলন পাওয়া যায়।
শস্য সুরক্ষা –
১) চারা ঢলে পড়া রোগ – বীজ অঙ্কুরিত হয়ে চারা বের হওয়ার পর মাটির নীচে থাকাকালীন বা উপরে ৫-৬ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত এই রোগ হতে পারে। নার্সারিতে চারা বের হওয়ার পর চারার গোড়ায় আক্রমণ হওয়ার পর গোড়া পচে যায়।
নিয়ন্ত্রণ –
-
বীজ শোধন কার্বেন্ডাজিম ২ গ্রাম/কেজি বীজ
-
চারা শোধন কার্বেন্ডাজিম ২ গ্রাম/লি. জল
-
ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি ১২৫০ গ্রাম/হেক্টর জমিতে জৈব সারের সাথে প্রয়োগ
২) বেগুনি লাল দাগ - আক্রান্ত গাছের পাতায় গোলাপি রং যুক্ত ছোট ছোট বসে যাওয়া সাদাটে দাগ দেখতে পাওয়া যায়। দাগের চারদিকের কিনারা লালচে বলয়যুক্ত। আক্রান্ত পাতা কুঁকড়ে হলুদ হয়ে শুকিয়ে যায়।
নিয়ন্ত্রণ –
-
বীজ শোধন কার্বেন্ডাজিম ২ গ্রাম/কেজি
-
ম্যানকোজেব ও কার্বেন্ডাজিমের মিশ্রণ ২ গ্রাম/লি. জলে মিশিয়ে ১০ দিন অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
৩) চোষী পোকা – গাছের রস শোষণ করে। পাতা ধীরে ধীরে বাদামী বর্ণের হয় এবং গাছের বৃদ্ধি ব্যহত হয়।
নিয়ন্ত্রণ –
-
ইমিডাক্লোপ্রিড ৩ লিটার জলে ১ মিলি অথবা অ্যাসিফেট ১ মিলি/লিটার জলে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
আরও পড়ুন - Paddy Seed Purification - ধানের ভালো ফলনের জন্য বীজ শোধনের পদ্ধতি
সংরক্ষণ –
ফসল তুলে ঘরের মেঝেতে ৩-৪ ইঞ্চি পুরু করে ছড়িয়ে ৮-১০ দিন রাখলে পেঁয়াজ শুকিয়ে যায়। কন্দের অগ্রভাগ টিপলে যদি বসে না যায়, তবে পেঁয়াজ শুকিয়েছে বলে বুঝতে হবে। ফসল তোলার পর বাল্বের ২-২.৫ সেমি. উপরের পাতা কেটে দিতে হবে। সঠিক পদ্ধতিতে ছাউনি দেওয়া বন্ধ ঘরে বাঁশের মাচার উপরে পেঁয়াজ ৪-৬ মাস পর্যন্ত রাখা যায়।
আরও পড়ুন -Pokkali Rice Farming: বিশ্বের প্রাচীনতম ও দীর্ঘতম ধান হলো পোক্কালি
Share your comments