সুন্দরবন (Sundarban Mangroves) কিভাবে আমাদের বরাবর বাঁচিয়ে রাখে সাইক্লোনের হাত থেকে?

ম্যানগ্রোভ (Sundarban Mangroves) এক প্রকার জলাভূমিযুক্ত বনাঞ্চল। তারা উপকূলীয় সম্প্রদায়ের জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেক পরিষেবা সরবরাহ করে থাকে। গাছেদের ঘনত্ব, বিভিন্ন প্রজাতির গাছেদের উপস্থিতি, জলাভূমি অঞ্চলে জলের প্রবাহ প্রভৃতি বৈশিষ্টের জন্য ম্যানগ্রোভ অঞ্চল বন্যা এবং ঝড়ের বিরুদ্ধে এক ধরণের বাফার বা প্রশমন অঞ্চল তৈরি করে।

KJ Staff
KJ Staff

২০ শে মে, ঘূর্ণিঝড় আম্ফান পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা এবং বাংলাদেশের উপকূলে ভূমিপতিত হয়েছিল। ২০২০ সালের ঘূর্ণিঝড় মরশুমের প্রথম গ্রীষ্মকালীন ঝড়, আম্ফান উপমহাদেশের পূর্ব অংশে তার যাত্রাপথ জুড়ে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, জীবন এবং জীবিকাকে বিধ্বস্ত করে দিয়ে যায়।

গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়গুলি দ্রুত গতি সম্পন্ন ঝড় যাদের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে অন্যতম হল একটি নিম্নচাপ কেন্দ্র, শক্তিশালী বাতাস এবং নিম্নচাপ কেন্দ্রের ঘের বরাবর বজ্র বিদ্যুৎ সহ প্রবল বৃষ্টিপাত। স্থলে আসার পর থেকে এই ঝড়গুলি দ্রুত শক্তি  ক্ষয় করতে থাকে। তবে নিম্ন-চাপ কেন্দ্রটি স্থলভাগের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় তারা প্রবল ঝড় , অভ্যন্তরীণ বন্যা, উঁচু ঢেউ, তীব্র বাতাসের ঝাঁকুনি এবং খুব ভারী বৃষ্টির সৃষ্টি করে।

ভারত আবহাওয়া অধিদফতর (আইএমডি) বঙ্গোপসাগরের উপর নিম্নচাপের অঞ্চল গঠনের কথা জানানোর প্রায় এক সপ্তাহের মধ্যেই, আমফান অতিকায় ঘূর্ণিঝড়ের আকার ধারণ করেছিল এবং প্রায় ১৫৫ কিমি প্রতি ঘন্টা গতিবেগ সহকারে পশ্চিমবঙ্গের বকখালীতে আঘাত হানে। ১৯৯৯ সালের পর থেকে প্রথমবার এই ধরণের প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের সম্মুখীন হয় ভারতীয় উপমহাদেশ।

বকখালী সুন্দরবনের ব-দ্বীপে অঞ্চলের অন্তর্গত। এখানে, গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্র নদী একে ওপরের সাথে যুক্ত হয়ে পরবর্তীতে বঙ্গোপসাগরে মিশে যায় এবং সঞ্চয়কাজ স্বরূপ হিমালয়ের পলি এবং বালি জমা করে দেয়। সুন্দরবন, ইউনেস্কোর দ্বারা স্বীকৃত একটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী এবং গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি। এটিই পৃথিবীর একমাত্র বৃহত্তম অক্ষত ও অবিচ্ছিন্ন ম্যানগ্রোভ জলাবদ্ধ জঙ্গল এবং বন্যজীবনের আবাস হিসাবেও এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি ঘূর্ণিঝড়ের প্রসঙ্গ থেকে ভাবা হয় তবে সুন্দরবন সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে তার ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবকে প্রশমিত করার ক্ষমতার জন্য।

আম্ফান যখন গঙ্গা বদ্বীপে আঘাত হানে, তখন কিছু অঞ্ছলে এটি থেকে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস উপকূল থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার ভিতর পর্যন্ত জল ঠেলে নিয়ে যায় যা পার্শ্ববর্তী জনবসতিকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। আইএমডি উপকূলবর্তী অঞ্চলে ১৫০-১৬০ কিমি / ঘন্টা পর্যন্ত বায়ুর গতিবেগ রেকর্ড করে। কিন্তু, ঘূর্ণিঝড়টি ব-দ্বীপ অঞ্চলে থাকা ম্যানগ্রোভের কারণে খুব কম ক্ষতি করতে সক্ষম হয়।

ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল (Sundarban Mangroves) -

ম্যানগ্রোভ এক প্রকার জলাভূমিযুক্ত বনাঞ্চল। তারা উপকূলীয় সম্প্রদায়ের জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেক পরিষেবা সরবরাহ করে থাকে। গাছেদের ঘনত্ব, বিভিন্ন প্রজাতির গাছেদের উপস্থিতি, জলাভূমি অঞ্চলে জলের প্রবাহ প্রভৃতি বৈশিষ্টের জন্য ম্যানগ্রোভ অঞ্চল বন্যা এবং ঝড়ের বিরুদ্ধে এক ধরণের বাফার বা প্রশমন অঞ্চল তৈরি করে।

ফ্লোরিডায় ২০১৩ সালে সংগঠিত হাওয়া একটি গবেষণা থেকে জানা গেছে যে একটি ম্যানগ্রোভ অরণ্য সব ধরণের ভয়ঙ্কর ঘূর্ণি ঝড়ের প্রভাবকে হ্রাস করতে পারে । ঝড় যত সহিংস হয় ম্যানগ্রোভগুলি তত বেশী কার্যকর হয়। ২০০০ দশকের গোড়ার দিকে একাধিক সমীক্ষার ফলাফল থেকে সামনে আসে যে ৬-১০ মিটার উচ্চতার ম্যানগ্রোভগুলি একটি ঘূর্ণিঝড়ের তরঙ্গকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনতে পারে। ম্যানগ্রোভের শ্বাসমূল এবং কাণ্ড একত্রে মিলে এমন এক জালিকাকার বিন্যাস তৈরি করে যারা তীব্র জলোচ্ছ্বাসের গতি কমিয়ে দেওয়ার জন্য স্পিড-ব্রেকারগুলির মতো কাজ করে।

দুঃখের বিষয় হল যে  বনভূমি কেটে ফেলা, ভূমি-সংস্কার এবং মাছ চাষ ও পর্যটনের মতো কার্যকলাপ সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্যের পরিমাণ এবং স্বাস্থ্য হ্রাস করেছে। বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যেই মনে করছেন যে আম্ফান ঝড়ের প্রভাব এত মারাত্মক হওয়ার ক্ষেত্রে সুন্দরবনের অবক্ষয়ের একটি ভূমিকা ছিল।

ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশের ১০,০০০-এর ও বেশি মানুষকে সরাসরি প্রভাবিত করেছে। ভারতে পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ কোন না কোন ভাবে এই ঝড় দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলে জানা গেছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কথা অনুসারে, ঝড়ের প্রভাবে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার সমান আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে রাজ্যকে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভবিষ্যতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধির আশঙ্কা - 

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভবিষ্যতে আরও ঘন ঘন এবং আরও বড় মাপের ঝড়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে, পাশাপাশি সমুদ্রের জলস্তরও ক্রমাগত বাড়ছে। মানব সমাজের উন্নয়ন, নগরায়ণ এবং কৃষিজমির রূপান্তরনের ফলে সুন্দরবন তথা ভারত জুড়ে ম্যানগ্রোভ অরণ্য যদি এই হারে কমতে থাকে তবে দেশের উপকূলীয় এবং উপকূল নিকটবর্তী সম্প্রদায় গুলির অবস্থা আরও খারাপ হবে তা অনস্বীকার্য।

বিশেষত সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করছে। ম্যানগ্রোভগুলি বেঁচে থাকার জন্য মিষ্টি জলের প্রয়োজন হয়। কিন্তু সমুদ্রের লবনাক্ত জল যত ভীতরে ঢুকছে ততই ম্যানগ্রোভ প্রজাতিদের স্তানান্তরিত হয়ে আরও ভীতরে যেতে হচ্ছে। ব্যারেজ, বাঁধ নির্মাণ এবং নদী প্রবাহের দিক পরিবর্তনের ফলে এই বদ্বীপ অঞ্চলগুলিতে নদীর পলিসঞ্চয় কাজকে ব্যাহত করে এই সমস্যাগুলিকে আরও খারাপ করে তুলেছে।

 এত কিছুর পরও এখনো পর্যন্ত যেটুকু ম্যানগ্রোভ অরণ্য বেঁচে রয়েছে তার সঠিক সংরক্ষণ ভবিষ্যতের ঘূর্ণিঝড়গুলির প্রকোপ থেকে আমাদের এবং উপকূলের ক্ষতি নাটকীয়ভাবে হ্রাস করতে পারে। সরকারের তরফ থেকে অনেক কোঠর আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিৎ ম্যানগ্রোভ অরণ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে। ম্যানগ্রোভ অঞ্চলে যে কোন বিনিয়োগের ফলাফল বহুগুনে ফিরে আসতে পারে।  ২০১৭ সালের একটি গবেষণা পত্র বলে ভারতে যে পরিমাণ মাছ ধরা হয় তার ২৩ শতাংশ অংশ শুধুমাত্র  ম্যানগ্রোভ অঞ্চলের জলজ মৎস্য পালন থেকে আসে যেখান থেকে প্রায় ৫৫ লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থান হয়।

সৈকত মান্না

Related Links - 

সুপার সাইক্লোন আমফানের (Amphan-hit areas) ক্ষতিপূরণ বাবদ রাজ্যের আবেদন এখন ৮০ হাজার কোটি টাকা

আমফানের পর এবার আসতে চলেছে ‘গতি’ (Cyclone Gati) নামের এই ঘূর্ণিঝড়

Published On: 07 June 2020, 12:19 PM English Summary: How mangroves protects us from cyclone

Like this article?

Hey! I am KJ Staff. Did you liked this article and have suggestions to improve this article? Mail me your suggestions and feedback.

Share your comments

আমাদের নিউজলেটার অপশনটি সাবস্ক্রাইব করুন আর আপনার আগ্রহের বিষয়গুলি বেছে নিন। আমরা আপনার পছন্দ অনুসারে খবর এবং সর্বশেষ আপডেটগুলি প্রেরণ করব।

Subscribe Newsletters